0
(0)


মো. আহছান উল্লাহ ও বিডি কামাল।
মানুষের জীবন একটি শক্তির উৎস। মানবিক একজন মানুষ নিজেকে যেমন সুন্দর করে তেমনী জাতি ও দেশকে মহান করে গড়ে তোলা তার জন্মজন্মান্তরের ব্রত। সেই ব্রত নিয়ে প্রকৃতির সুরেলা সহাবস্থানকে মেনে চলা সাজানো গোছানো একটি গ্রাম নাম বাকাই। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার প্রত্যন্ত এই বাকাই গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন শিক্ষানুরাগী সাধক হরিগোবিন্দ রায় চৌধুরী। অজোপাড়াগায়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার মহান ব্রত নিয়ে নিজের ১ একর ১০ শতক জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন হরিগোবিন্দ সংস্কৃত কলেজ। পাশেই তার ছেলে নিজ জমির উপর সর্গীয় নিরাঞ্জন রায় চৌধুরি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বাকাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
দুখের বিষয় হরিগোবিন্দ সংস্কৃত কলেজটি শত বছর পার করেও এমপিওভুক্ত হতে পারেনি। অবিস্বাশ্য এই কলেজের অধ্যক্ষের বেতন মাসে ১৭৯ টাকা ৪৫ পয়সা। কলেজটি রক্ষা করতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন অধ্যক্ষ নিখিল রায় চৌধুরী। তিনি হরিগোবিন্দ রায় চৌধুরির নাতি। সমাজের হিতের জন্য পূর্ব পরুষদের রেখে যাওয়া স্বৃতি ধওে রাখতে এবং শিক্ষার প্রতি ভালোবাসার টানে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন নির্দ্বিধায় নিশব্দে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, শিক্ষানুরাগী পন্ডিত হরি গোবিন্দ রায় চৌধুরী ১৮৯৩ সালে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য সেবা, নৈতিকতা,ধর্মীয় ও শিক্ষার আলো ছড়াতে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত এ কলেজে প্রতি বছর কাব্য, ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, পুরাণ, পুরোহিত্য ও স্মৃতি শাস্ত্রসহ ৬টি বিষয়ের উপর শিক্ষা দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের ৩ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স করে সনদ নিতে হয়। বর্তমানে কলেজটিতে অধ্যক্ষসহ ৩ জন শিক্ষক ও ১ জন অফিস সহকারী কর্মরত আছেন।
প্রতি বছর এপ্রিল মাসে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় এবং ডিসেম্ভার মাসে পরিক্ষা নেয়া হয়। নানা প্রতিকুলতার কারনে নিয়মিত ক্লাস করানো যায় না বছরে ১২০টি ক্লাস করানো হয়। বরিশাল বিভাগে একটি মাত্র কলেজ। ১৯৭১ সালে কলেজটির অবকাঠামো পুড়িয়ে দেয় পাক হানাদাররা। ওই সময় এলাকার অনেক হিন্দু পরিবারের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোন রকমে গড়ে তোলা হয় কলেজের অবকাঠামো। ২০০১ সালে ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ থেকে তিন তলা একটি ভবন নির্মান করে দেয়া হয়। ওই ভবনের ছয়টি কক্ষে চলছে শিক্ষাসহ দাপ্তরিক কাজকর্ম।
কলেজের শিক্ষকদের অমানবিক জীবনযাপনের বিষয়টি অধিকাংশ লোকের অজানা। কলেজের অধ্যক্ষের মাসিক বেতন ১শ ৭৯ টাকা ৪৫ পয়সা। সহকারি শিক্ষকের বেতন ১শ ৪৯ টাকা ৪৫ পয়সা। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ভাতার তুরনায় সংস্কৃত কলেজে কর্মরতদের আর্থিক বিপরীত চিত্র চরম বৈষম্য প্রকাশ করে। কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতার কারনে এর পাঠ্য বই পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায় না। অধিকাংশ বই ভারত থেকে সংগ্রহ করতে হয়।

সংস্কৃত কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও বাকাই নিরাঞ্জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক পার্থ সারতি হালদার বলেন, ১৯৭৭ সালে বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তারা ১১৫ টাকা বেতন পেতেন, সংস্কৃত কলেজের শিক্ষকরাও তখন একই হারে বেতন পেতেন। সময়ের পরিক্রমায় সংস্কৃত, পালি টোল, চতুষ্পঠি কলেজের অধ্যক্ষ মাসে বেতন পান ১৭৯ টাকা ৪৫ পয়সা। পৃথিবীর কোনো দেশে শিক্ষকদের ১৭৯ টাকা বেতন নেই। এটা চরম বৈষম্য। এ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির ৫ দফা দাবিতে তারা বিভিন্ন সময় আন্দেলোন করেছেন। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১৪,২০১৭ এবং ২০২০ সালে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ কিন্তু রহস্যজনক কারনে উদ্যোগ আর আলোর মূখ দেখেনি।
হরিগোবিন্দ সংস্কৃতি কলেজের সহকারি শিক্ষক চন্দন বসু আক্ষেপ করে বলেন,আমাদেরকে অনেক একটু ভিন্ন চোকে দেখে। টিজ করে সমালোচনা করে এমনকি পরিবারের কাছেও অনেক সময় মূখ দেখাতে লজ্জা হয়। আর এতে আমরা ক্ষতবিক্ষত। তিনি আরো বলেন শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ভাতা ছাড়াও একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন খরচ থাকে। অথচ কোন বরাদ্দই নাই। এ খরচের চাপ একটা সময় শিক্ষকদের কাঁেদই পরে।
অফিস সহকারি অজয় রায় বলেন, কেমন চাকুির করি বলতে পারি না। রাগ করে অনেক সময় চলে যাই স্যারেরা আবার বুঝিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসে। বেতন ছাড়া চাকরি এখন আর ভালো লাগে না।
কলেজের প্রাক্তন ছাত্র প্রদীপ কুমার মন্ডল বলেন, যে যুগে শিক্ষা কঠিন বিষয় ছিল। সংস্কৃত ও পালি এ ধরনের টোল ঘরে প্রাথমিকসহ বিভিন্ন শিক্ষা দেয়া হতো। তাও আবার সব জায়গায় ছিল না। কালের বিবর্তনে শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন হলেও আদি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আজও কোন উন্নয়ন হয়নি। আমি এই কলেজ থেকেই ২০১৩ সালে কাব্যতীর্থও অধ্যায়ন কওে সনদ অর্জন করে একটি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় কর্মরত আছি। অনেক কষ্ট লাগে অর্থ শ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠান রক্ষা করা শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারিদের দৈন্যতা দেকে। সংস্কৃত কলেজগুলো সরকারিকরন করার দাবি জানাচ্ছি। কেননা এ সব প্রতিষ্টানের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ঐতিয্য।
১৯৮৮ সালে বাকাই হরিগোবিন্দ সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহন করেন পন্ডিত নিখিল রায় চৌধুরী। তিনি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা পন্ডিত হরিগোবীন্দ রায় চৌধুরির নাতি। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসার টানে এবং কলেজটি রক্ষা করতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। পর্দার অন্তরালে থাকা অনন্য অসাধারন মানুষটি চরম দৈন্যতার মাঝে কলেজটি সচল রাখার আপ্রান চেস্টা চালাচ্ছেন।
অধ্যক্ষের ছেলে বিপ্লব রায় চৌধুরি বলেন,পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া স্বৃতি ধরে রাখতে কলেজটির দেনা, অচল অবস্থা নিরশন করতে গিয়ে বাবা বিভিন্ন সময় তিন বিঘার বেশী জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। হারানো জমিগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় অর্ধকোটি টাকা। এই কলেজ রক্ষা করতে বাবা আবারো অনেক টাকা দেনা হয়েছেন। যে কারনে পুনরায় জমি বিক্রি করতে চাইলে আমরা বাঁধা দেই। কেননা বর্তমানে যে জমি আছে তাতে পরিবারের এক বছরের খোরাক পাওয়া যায় জমি বিক্রি করলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। এ নিয়ে মা বাবার মধ্যে প্রায়ই কথার কাটাকাটি হয়।
অধ্যক্ষ পন্ডিত নিখিল রায় চৌধুরী বলেন, একজন শিক্ষক নৈতিকতা গড়ে তোলার এবং মানুষ গড়ার মূল আকাঙ্খাকে মেনে চলেন। একজন শিক্ষককে কঠোর থেকে কঠোরতম পরিশ্রম করতে হয়। পূর্ব পুরূষদের রেখে যাওয়া সমাজের হিতের কাজগুলো কষ্ট হলেও আমাদেরই করতে হবে। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন আমাদের এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন হোক আমাদের পন্ডিতরাই চান না কেন চান না প্রশ্ন করলে তিনি তা প্রকাশ করতে রাজি হননি। সংস্কৃত কলেজগুলোর উন্নয়ন ও শিক্ষক কর্মচারিদের ক্ষেত্রে বৈষম্য আগামি প্রজন্ম যেন ঘৃনার চোখে না দেখে, এমনটিই প্রত্যাশা করেন তিনি। বেতন ভাতা যাই পাননা কেন আমৃত্যু এই পেশা আকড়ে থাকতে চান।

 

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.