শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন মোস্তফা জামান
রফিকুল ইসলাম ।
খুব সকালে ছুটেন স্কুলে। কোমলমতি ছেলে মেয়েদের শরীর চার্চার মাধ্যমে দিনের শুরু করেন। তারপর অভিভাবকদের সঙ্গে সমাবেশ করেন। ততক্ষনে ক্লাস শুরু হয় হয়। এক রুম থেকে ছোটেন আরেক রুমে। কোন শিক্ষক কিভাবে পড়াচ্ছেন তা তদারকির জন্য।
ছুটাছুটিতে নয়টা বেজে যায়, তখন ছুটেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৃষি, দুযোগ ব্যবস্থাপনা হয়ে ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অনুষদে গিয়ে সেই ছুটাছুটির অবসান ঘটে। ভাবছেন তার ছোটাছুটি শেষ, তা নয়। শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে নিজ রুমে প্রবেশ করতেই সহকারি জানিয়েন দেন উপাচার্যের খোজাখুজির কথা। তাকে ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কাজ হয়েছে, এমনটির নজির নেই। দিনের শুরু থেকে বিকেল অবধি তার প্রতিনিয়ত ছুটে চলা।
এই তিনি হচ্ছে আ,ক,ম মোস্তফা জামান। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক পদে কর্মরত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ সমুন্নত রাখতে সাধ্যমত বিবিধ কর্মকান্ড পরিচালনা করার চেষ্টা করে আসছেন আজীবন। আছেন অনেক সংগঠনে। গড়েছে অনেক সংগঠনও।
সাগরতীরের বরগুনার বাঁশবুনিয়া ইউনিয়নের পাজরাভাঙ্গা গ্রাম। সেই গ্রামের আব্দুল গফুর হাওলাদার ও আমেনা বেগমের দম্পতির ঘরে ১৯৫৭ সালের ১৬ অক্টোবর আ,ক,ম মোস্তফা জামানের জন্ম। ছোট সময় বাবা গফুর হাওলাদার কলেরায় আক্রান্ত হলে ‘জিটি’ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। অধ্যাপক জামানের পরিবার রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন। সেঝভাই আনসার উদ্দিন পটুয়াখালী কলেজে অধ্যয়নের সময় ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারের কারনে মোস্তফা জামান ছিলেন ভালো বক্তা।
মোস্তফা জামান তখন স্থানীয় কেওড়াবুনিয়া স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ছেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্টভাষা বাংলা ও ছয় দফার পক্ষে মোস্তফা জামান তিন কিলোমিটার পায়ে হেটে ছাত্রদের মিছিলের সাথে বরগুনা শহরে আসেন। বর্তমান বরগুনা সরকারি কলেজের বিপরীত দিকের খোলা মাঠে ছাত্র সমাবেশে অধ্যাপক জামান পাকিস্তানি শোষক-অত্যাচারিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। পরবতীতে ১৯৬৯ ছাত্র আন্দোলন ও রাজবন্দীদের মুক্তির আন্দোলনে ব্যাপক অংশ গ্রহন করেন। সদ্যকারামুক্ত বাঙালির অবিস্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৬৯ সালে বরগুনা স্কুল মাঠে ভাষন দেন। ছাত্রদের শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর সে জনসভায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন মোস্তফা জামান।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আসমত আলী সিকদারের নৌকার পক্ষে অষ্টম শ্রেনীতে পড়ুয়া মোস্তফা জামান নৌকার পক্ষে প্রচারনা অংশ নেন। নির্বাচনের দিন দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা বঙ্গবন্ধু ছবি সন্বলিত নৌকার পোস্টার ছিড়ে ফেলে। তখন জামান ওই ঘটনার প্রতিবাদ করেন। এক পর্যায়ে জামান মারামারিতে লিপ্ত হন। তখন কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জামানকে আটক করে। তৎকালিন ছাত্রলীগ নেতা বর্তমান বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির তাকে মুক্ত করেন। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর নবম শ্রেনীতে পড়ুয়া মোস্তফা জামান বন্ধুদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ শুরু করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা যখন বরগুনা শহর ছাড়লেন, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোস্তফা জামান পাকবাহিনীর তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ইউনুস শরীফের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী উরবৃুনিয়া, গৌরীচন্না, বেতাগী পৌঁছে দেয়ার কাজ করেছেন। ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভুর বাবা এবং দাদা পাকবাহিনীর হাতে নিহত হবার পর সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু পরিবারের সাথে জামানের বড়ভাই আনসার উদ্দিনের নিবিড় সম্পর্ক হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত বরগুনার প্রায় সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মোস্তফা জামান ছিলেন অগ্রভাগে। এসডিও সিরাজ উদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে “পাক্ষিক বরগুনা” পত্রিকা প্রকাশে অসামান্য অবদান রাখেন।
১৯৭৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মোস্তফা জামান যশোর বোর্ডে মেধা তলিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের পর এসডিও খবর শুনে বিচলিত হন। অর্থাভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক এডমিন্সট্রেশনে ভর্তি বাতিল করে, বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৭৬ সালে মস্কো চলে যান।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে অধ্যয়নকালে সেদেশে সমাজতন্ত্র নির্মানের কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ১৯৭৭ সালেই ক্রাসনোদার আঞ্চলিক বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠনের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। নিখিল সোভিয়েত বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে স্থানীয় বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠনের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মোস্তফা জামান সংগঠনের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তিতে ১৯৮১ ও ৮২ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন।
চাকুরি জীবন
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে অবিচল অধ্যাপক আ.ক.ম মোস্তফা জামান।
স্বাধীনতা বিরোধীরা চাকুরীর শুরু থেকে জনাব আ.ক.ম মোস্তফা জামানকে নানাভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করে আসছে। এখনো করে যাচ্ছে। নানা হুমকি এমন কি চাঁদা দাবী, জীবন নাশের হুমকিও দিয়ে থাকে।
আ.ক.ম মোস্তফা জামান, অধ্যাপক, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসুরী প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালী কৃষি কলেজ ১৯৮৪ সালে প্রভাষক পদে যোগদান করে অদ্যাবদি চাকুরীতে আছেন। বর্তমানে পবিপ্রবিতে কর্মরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে সব অধ্যাপক রয়েছেন তিনি তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম।
শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন জামান
অধ্যাপক আ.ক.ম মোস্তফা জামানের উদ্যোগে বরিশাল সরকারী ভেটেরেনারি কলেজ পবিপ্রবির অনুষদ হিসেবে আত্মীকৃত হয়। স্নাতকোত্তর (এমএস,পিএইচডি) চালু, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অনুষদ ও ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এন্ড এডমিনিস্ট্রেশন অনুষদের তিনি উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা ডিন। ক্যাম্পাসে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য উচ্চমান সম্পন্ন সৃজনী বিদ্যানিকেতন নামে একটি স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যেটি বরিশাল বোর্ডে চতুর্থ অবস্থান ধরে রেখেছে।
গড়ে তুলেছেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ সমুন্নত রাখতে সাধ্যমত বিবিধ কর্মকান্ড পরিচালনা করার চেষ্টা করে আসছেন আজীবন। ২০০৭ সালে ‘‘ সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১’’ এর শাখা গঠন করে বিএনপি জামায়েত জোটের বিপক্ষে আদর্শিক লড়াই জোরদার করেন। ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা গবেষণা পরিষদ এবং ২০১২ সালে নীলদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। কৃষি কলেজ আমলে দ্ইুবার এবং বিশ্ববিদ্যালয় আমলে ২ বার শিক্ষক সমিতিতে নীলদলের হয়ে পূর্ন প্যানেলসহ বিজয়ী হয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় উন্নয়ন, শিক্ষা ও গবেষণায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য আপোষহীন চেষ্টা করে আসছেন। ক্যাম্পাসে জাতির জনকের আবক্ষ ভাস্কর্য ও ৭ জন বীর শ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য স্থাপনে নিজেরা চাঁদা দিয়ে সম্পন্ন করতে নেতৃত্ব প্রদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, রেজিস্ট্রার, পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, পাঁচটি অনুষদের ডিনের দায়িত্ব এবং ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নেতৃত্ব প্রদান করার চেষ্টা করে আসছেন। বর্তমানে ‘‘মুজিব শতবর্ষ’’ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করছেন।