0
(0)


মো.আহছান উল্লাহ।
মহা মারি করোনা কোভিট নাইন্টিন আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে। প্রকৃতির কাছ থেকে এতদিন আমরা যা নিয়েছি তা এখন ফেরত দেয়ার সময় এসেছে। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মানুষ। প্রকৃতির নিরাপদ আশ্রয়ে মানুষ এবং প্রানী জগতের স্বাভাবিক বিকাশ মানব সভ্যতাকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু মানুষের অতিভোগ স্পৃহা এবং অপ্রয়োজনীয় বিলাস সেই স্বাভাবিক যাত্রাকে ব্যাহত করেছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। প্রকৃতির সম্পদ প্রয়োজনীয় ব্যাবহারের বদলে লুন্ঠিত হয়েছে। মানুষের ভোগ চাহিদা পুরণে। এই ভোগ চাহিদা পুরণের প্রয়োজনে প্রকৃতি লুন্ঠনের অনুষঙ্গি হয় রাসায়নিক সার ও বীষাক্ত কীটনাষক। উপযোগ হয় ই-বর্জ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার। ইন্টারনেট,বেতার,তরঙ্গ। গবেষনার নামে একদল প্রভাবশালী সুযোগ সন্ধানী পারমানবিক ও জিবানু অস্ত্রের মজুদ গড়ল কি শুধু অর্থ আর প্রতিপত্তির কারনে। এ কথাটা বলা কি বেশী অন্যায়। আসলে এসব আবিস্কার বা ব্যবহার মানব কল্যানে সাংঘর্ষিক নয়। এখানে প্রয়োগ বিধিতে রয়েছে অনেক পার্থক্য। প্রকৃতি এ সবের অত্যাচারে হয়ে পরেছে বিপর্যস্ত। মানুষের আশ্রয়ে প্রকৃতি যখন বিপর্যস্ত হয়,তখন আশ্রিত মানুষের অবস্থাও হয় নাজুক নাজেহাল ও বিপর্যয়কর। করোনার মত মহামারিসহ নানা রোগ,শোক,সন্তাপ মানুষকে করে তোলেছে প্রকৃতির বন্ধনহীন উন্মুল প্রান প্রজাতি। এই মহা-বিপর্যয়ের সময়ে দুনিয়াব্যাপী আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাবার তাগিদ বোধ করছে মানব সম্প্রদায়।

১৯৫০- এর দশক থেকে দেখা যায় বিশ্ব পরিবেশ দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। চারটি মূল উপাদানে আমাদের বাস্তসংস্থান। মাটি,পানি,বাতাস এবং ভূ-জীববৈটিত্র। আমাদের এ বাস্তসংস্থানে একটা বড় ধাক্কা লেগেছে, এটাকে যদি অপূরনীয় ক্ষতির ধাক্কা বলি, অন্যায় হবে না। পেছনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। শিল্পবিপ্লবের দাবীদার রাষ্ট্রগুলোর শিল্পবিপ্লবের নামে কয়লা,খনিজ তেল,সিমেন্ট,ইস্পাত এর ধারাবাহিক ব্যবহারে বদলে গেল বিশ্বের শিল্প-মানচিত্র। পরিবেশ বান্ধব ছোট শিল্প গুলিকে হারিয়ে যুক্ত হল উন্নত শিল্প বিপ্লব।
এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটতে শুরু করল কয়লার ইঞ্জিন দিয়ে টানা রেল গাড়ি। সেগুন,শাল,লোহান গাছের জঙ্গল সাফ করে দেয়া হল রেল লাইনের স্লিপার। প্রকৃতির সাথে প্রতিযোগিতা শুরু করল প্রকৌশলী আর বিজ্ঞানীরা। তারা দেখাতে চাইল আমরা পৃথিবীর সব বদলাতে পারি ! তবে সে বদলানোটা প্রাথমিকভাবে কিছুটা সূফল দিয়েছে। মানব সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার কিছু উন্নতি হতে আরম্ভ হল। অনুসন্ধানে দেখা যায় ১৯৬১ সালের তুলনায় বিশ্বে মানুষের মাথাপিছু খাদ্যর যোগান ৩০% বেড়েছে ঠিক কিন্ত এর নেপথ্যে কৃষি জমিতে নাইট্রোজেন প্রয়োগ বেড়েছে ৮০০% সেচের পানির চাহিদা বেড়েছে ১০০%। পরিবেশের ভারসাম্যের কথা কেউ ভাবেননি বলেননি।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি টনক নরেছিল বিজ্ঞানীদের । কিন্ত বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার কারনে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কোন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। শুরু হল জিবানু আর পারমানবিক রশদের মহা-মরন। সুপার পাওয়ার নামের তিব্রতার জোট। ধর্মীয় বিভাজন। মানব কল্যানের নামে হিংশ্রতার কাছে হাড় মানতে শুরু করল প্রকৃতি। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার উন্নতির নামে প্রতিযোগিতা আরো বিপদগামী করেছে মানব সম্প্রদায়কে। সব ফাইল বন্ধি হয়ে উল্টো পথে হাটল।
১৯৭২ সালে স্টকহোম বসুন্ধরা সম্মেলনে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা প্রথম জানান দিলেন। শিল্প কারখানার ধোঁয়া দুষিত করছে বাতাস। বিষিয়ে দিচ্ছে পানি। যত্রতত্র ফেলে দেয়া কঠিন বর্জ্য জনস্বাস্থ্যে বিপদজনক হচ্ছে। নিরব ঘাতক হিসেবে বসে আছে ই-বর্জ। আমাদের জীবনধারার নির্মল বাতাস আর পানি দূষিত হচ্ছে। সমষ্টিগতভাবে ভূ-জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ক্রমান্যয়ে বাস্ততন্ত্রের কাছে তাদের কার্য্যকারিতা হারাচ্ছে !
অনেক দেরিতে হলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন বিগত ৫০-৬০ বছরে বাস্তসংস্থানতন্ত্রেও যে অবক্ষয় হয়েছে গত ৮ লক্ষ বছরের ইতিহাসে পৃথিবীতে কখনও ঘটেনি।
এই শতাব্দী সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম শতাব্দী হতে যাচ্ছে! ১৯৬৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে উত্তর মেরুপ্রদেশের প্রায় ২৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে তুষারের আবরণ গলে গেছে। ১৮৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সাগরের জলের উষ্ণতা ০.৮৭০ সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। ১৯০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে স্থলভাগের উষ্ণতা বেড়েছে ১.৪১০ সেন্টিগ্রেড। ১৮৫০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জল-স্থল মিলিয়ে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা প্রায় ১০ সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর ০.৫০ সেন্টিগ্রেড বাড়লেই সমূহ বিপদ।
পৃথিবীর বাতাসে এই মাত্রাতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস শুধু শিল্পাঞ্চল ও যানবাহন থেকে মিশছে এমন নয়, এই ক্ষতিকর গ্যাসের এক-চতুর্থাংশ ভূমিভাগ থেকেই বাতাসে মেশে।
কার্বন ডাইঅক্সাইড মেশে বন কেটে ফেলার ফলে, মিথেন আসে ধানজমি আর আমাদের ফেলে দেওয়া পচনশীল বর্জ্য থেকে, নাইট্রাস অক্সাইড মেশে রাসায়নিক সার থেকে।
পৃথিবীর ৪৬% ভূমি শুষ্ক যেখানে বাস করেন প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ আর ২০০ কোটি মানুষের বাস উপকূলে এবং প্রায় ৮০ কোটি মানুষ থাকেন মেরুপ্রদেশে বা পার্বত্য অঞ্চলে। ভূ-উষ্ণায়নের প্রভাবে সারা পৃথিবী বিপন্ন হলে তবে এই তিনটি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সর্বাধিক। আই পি সি সি-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, আগামী কয়েক দশকে শুখা এলাকায় বৃষ্টি কমবে এবং আর্দ্র এলাকায় বৃষ্টি বাড়বে। সাগর এগিয়ে আসবে উপকূলের দিকে।
দেখা যাচ্ছে যে শিল্পবিপ্লব বা তারপর— অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকে যত কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2) বাতাসে মিশেছে তার ৪০ শতাংশ মিশেছে গত পাঁচ বা চার দশকে !
দ্রুত পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। আমাদের পৃথিবীর যে তিন ভাগ সমুদ্র! বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৮৫০ সালের তুলনায় এই শতাব্দীর শেষাশেষি পৃথিবী অন্তত ৩০ সেন্টিগ্রেড উষ্ণ হয়ে উঠবে! উত্তরমেরু অঞ্চলে ও হিমালয়ের অঞ্চলে যে বরফ জমে আছে তা প্রায় ৪ শতাংশ হারে প্রতিবছর গলে যাচ্ছে! অনেকের আশঙ্কা, এই শতাব্দীর মাঝামাঝি উত্তরমেরু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে আর কোনও বরফই দেখা যাবে না। ২০১৯ সালের জুন মাসে ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, ২০০০-২০১৬ সালের মধ্যে হিমালয়ের হিমবাহগুলি ওপর দিক থেকে অন্তত ৪৫ সেন্টিমিটার গলে গেছে, যা পূর্ববর্তী কয়েক বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিবছর শীতকালে হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তুষারের আবরণে ঢেকে যায়; মার্চ মাসের শেষ থেকে ওই তুষারগলা cvwb ও তার উপনদীদের বাঁচিয়ে রাখে। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে তুষার-হিমবাহ এই হারে গলতে থাকলে প্রথম কয়েক বছর নদীতে জল বাড়বে এবং পরে কমে যাবে। প্রথমে উপনদী ও পরে বড় নদীও শুকিয়ে যাবে বহমান থাকবে শুধু বর্ষাকালে। গত এক শতাব্দীতে হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে পৃথিবীর সমুদ্রতল প্রায় ১৯ সেন্টিমিটার উঁচুতে উঠেছে— প্রতিবছর ১.৭ থেকে ২ মিলিমিটার হারে। কিন্তু এখন সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে প্রতি বছর ৩.৬ মিলিমিটার হারে। গত এক শতাব্দীতে আমাদের সুন্দরবন উপকূলে ভূমি ক্ষয়ে গেছে। সমুদ্র এগিয়ে এসেছে। সমীক্ষায় প্রকাশ, এই শতাব্দীর শেষে বঙ্গোপসাগর আরও অন্তত ৫২ সেন্টিমিটার ফুলে উঠে সুন্দরবনকে আরও গ্রাস করবে।
প্রকৃতির সম্পদ উদ্ধারে,সুস্থ্যতা অর্জনে প্রকৃতির সম্পদ সঠিক ব্যাবহারে এবং মানব জীবনকে প্রকৃতির অনুগামী তথা স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনতে এ উদ্যোগ পাঠকের,মানুষের কাজে আসলেই আমরা কৃতার্থ হবো। আসুন আমরা সবাই কৃত্রিমতার বন্ধন ছিন্ন করে ফিরে যাইÑযা কিছূ স্বাভাবিক,যা কিছূ প্রকৃতিরÑতার কাছে। সমস্বরে বলিÑ ফিরে চলো মাটির টানে।
বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার বিকাশের এই যুগে তাই মানুষ আবার বোধ করে Ñপ্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়াটা হবে মানুষ,মানব সভ্যতা,মানব স্বাস্থ্য রক্ষার উৎকৃষ্ট উপায়। ভোগের বিপরীতে পেতে চায় নিরাপদ,সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন। চলবে—-
লেখক,মো,আহছান উল্লাহ
সাংবাদিক দৈনিক কালের কন্ঠ, কৃষি,ভেষজ গবেষক ও উদ্ভাবক।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.