আগৈলঝাড়া ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ ও প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা ভেগাই হালদারের ১৬৬তম জন্ম ও ৮৬তম মৃত্যু বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী

0
(0)

তপন বসু, বিশেষ প্রতিনিধি
২৬ জানুয়ারী, ২০১৯। প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পুরণ করল আগৈলঝাড়ার ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা ক্ষণজন্মা মহাত্মা ভেগাই হালদারের ১৬৬তম জন্ম ও ৮৬তম মৃত্যু বাষিকী আজ রবিবার ২১ আষাঢ়। শত বর্ষের এই শুভক্ষণে ভেঘাই হালদারকে নিবেদন করছি অবিনত মস্তকে অকৃতিম শ্রদ্ধা।
“আধুনিক সমাজ ও দেশ গড়ার জন্য প্রতিটি শিশুকে শিক্ষিত হতে হবে। প্রতিটি ঘরের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হলেই দেশ এগিয়ে যাবে।” সরকারের আজকের এই শিক্ষা নীতির অন্তর্নিহিত কথা হয়ত আজ থেকে ১শ বছর আগে পশ্চাদপদ আগৈলঝাড়ার ভেগাই হালদার বুঝতে পেরেছিলেন। ক্ষণজন্মা বিচক্ষণ এই ভেগাই হালদার শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া সমাজকে আলোকিত করতে প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ পরিবারের ছেলে মেয়েদের সু-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ১৯১৯ সালের ২৬ জানুয়ারী আগৈলঝাড়ার অশিক্ষিত ভেগাই হালদার তাঁর নিজের জায়গায় নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন “ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমী”।
অশিক্ষিত ভেগাই হালদার শিক্ষিত সমাজ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গৈলা গ্রামের প্রতিথযশা কৈলাশ সেনকে নিয়ে প্রথমে পাঠশালা হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। কালের বিবর্তনে আজ তা আগৈলঝাড়া উপজেলার শত বর্ষের প্রাচীন বিদ্যাপীঠের স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে সুনাম ছড়াচ্ছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও।

 

বিদ্যালয় এডহক কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপুল চন্দ্র দাস ও উপজেরঅ চেয়ারম্যান বিদ্যালয়ের সাবেক বিদ্যোৎসাহী সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত জানান, বর্তমানে এই বিদ্যাপীঠে প্রায় ২ সহ¯্রাধিক শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। প্রায় ৫ একর জমির উপর একাডেমীক ভবন ও ৩০টি শ্রেণি কক্ষের সুবিধা পাঠদান করাচ্ছেন ২২ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। ভাল ফলাফলের দিক থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি অন্যতম।
বিপুল চন্দ্র দাস আরও বলেন, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে সমাজ ব্যবস্থাকে শিক্ষিত করার প্রয়াসে ভেগাই হালদার সকল ধর্মের লোকের শিক্ষার জন্য একটি পাঠশালা স্থাপন করেন। ভেগাই দেশ বরেণ্য অশ্বিনী কুমার দত্তের সাহচর্য ও পরামর্শে গৈলার কৃতী সন্তান কৈলাশ চন্দ্র সেনকে সাথে নিয়ে হর ভূষণ হালদাকে প্রধান পন্ডিতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠশালার শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। পাঠশালা প্রতিষ্ঠার পর তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের ঢল নামতে শুরু করলে অবকাঠামো বড় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অবকাঠামো বাড়াতে ভেগাইকে সহাঅনুভুতি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় নিবারণ চন্দ্র দাস, নিশি কান্ত মিস্ত্রী, সীতা নাথ হালদার, গোপাল হালদার, মফিজ উদ্দিন খান, মুন্সী দলিল উদ্দিন পাইক, ধনাই পাইকসহ আরও অনেকে। ওই সময় দশম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করা স্কুলগুলোর নাম ছিল ‘হাই ইংলিশ স্কুল’ (এইচ,ই,স্কুল)। ভেগাই তার স্বপ্নের পাঠশালাটিকে কাঙ্খিত বিদ্যাপীঠে রুপ দিতে উপমহাদেশে বিভিন্ন বিত্তশালীদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
তিনি নিজে লেখাপড়া না জানায় অর্থ সংগ্রহের জন্য ওই সময় একটি খাতা (ডায়েরী) ব্যবহার করতেন। ওই ডায়েরীতে স্কুলের জন্য দানকারী দাতাগণ তাদের অনুদান ও সংক্ষেপে তাদের অভিপ্রায় লিখতেন। যার মধ্যে প্রখ্যাত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, স্বদেশী আন্দোলনের নেত্রী সরোজিনী নাইডু, বাংলার বাঘ শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, আরসি বøাকহুড অন্যতম। তার ওই অনুদানের খাতা আজও স্কুলে রক্ষিত আছে।
এর পর আর থেমে থাকেনি ভেগাই হালদারের ইচ্ছা শক্তি। বিদ্যালয়টি আরও প্রসারিত করার জন্য জমির প্রয়োজন দেখা দিলে ভেগাই হালদার রামচরণ হালদারের কাছ থেকে জমি চাইলে রাম চরণ বিনা বাক্যে পাঠশালার জন্য জমি দান করেন। বর্তমানে অবস্থিত বিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ জায়গাই প্রায় রাম চরণ দাসের দান করা।
তবে ভেগাই হালদারের জীবদ্দশায় তার স্কুলটি স্থায়ী মঞ্জুরী দেখে যেতে পারেননি। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ তার প্রতিষ্ঠিত ভেগাই হালদার পাবলীক একাডেমী (বিএইচপি একাডেমী) শত বর্ষের আধুনিক বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত।
ভেগাই হালদার সমাজের অবহেলিত লোকজনের কষ্ট বুঝতে পেরে উদ্যোগ নিয়ে আগৈলঝাড়ায় একটি জনসভা করেন। ওই সভায় সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন দেশ বরণ্য কবি ও সমাজসেবক অশ্বিনী কুমার দত্ত, আচার্য্য প্রফুল্ল¬ চন্দ্র রায়, শের-ই বাংলা একে ফজলুল হক, ভারতের বিখ্যাত পন্ডিত ও কংগ্রেস নেতা মদন মোহন মালব্য এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের বোনের মেয়ে সরলা দেবী। ভেগাই হালদারের উদ্যোগে ওই জনসভা সংবাদ তৎকালীন ভারতের আনন্দবাজার ও অমৃতবাজার পত্রিকায় যথেষ্ট গুরুত্বদিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বলে জানা গেছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে ভেগাই হালদারের নাম ভারতবর্ষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে পরিচিত লাভ করেন। পরাধীনতার শক্তি থেকে দেশকে মুক্ত করতে রাজনীতিতেও ভেগাই হালদার অংশগ্রহণ করেন।

ক্ষণজন্মা মহাত্মা ভেগাই হালদার ১২৬০ বঙ্গাব্দের ২১ আষাঢ় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি মানব কল্যানে জীবন উৎসর্গ করে ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ২১ আষাঢ় ৮০ বছর বয়সে জন্ম দিনে জাগতিক মায়া ত্যাগ করে নশ্বর দেহত্যাগ করেন।
অন্যান্য বছর বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ভেগাই হালদারের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পালন করা হলেও এবছর জাতির পিতার ভাগ্নে, শহীদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সুযোগ্য সন্তান স্থানীয় এমপি আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ’র পৃষ্ঠাপোষকতায় ভেগাই হালদারকে ধর্ম ও বর্ণের উর্ধে রেখে সমগ্র

জনগোষ্ঠির সার্বজনীন শিক্ষাগুরুর মর্যাদাসীন আসনে বসাতে গঠন করা হয়েছে ২১ সদস্য বিশিষ্ট অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন কমিটি। অনেক দেরীতে ভেগাইকে চিরঞ্জিবী করতে বাস্তবায়ন কমিটিকে সাদরে গ্রহন করে সাধুবাদ জানিয়েছেন আগৈলঝাড়ার সর্বস্তরের জনগন।
একই দিনে জন্ম ও মৃত্যু এবং তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি সবার কাছে ‘মহাত্মা’ ভেগাই হালদার নামে পরিচিত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠ সংলগ্ন দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে তাঁর সমাধি মন্দির। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মনি কোঠায় ভেগাই তার কর্মজীবনের জন্য আগৈলঝাড়ায় চির অ¤øান ও অবিনাশী হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.