0
(0)

আহছান উল্লাহঃ
পেয়ারা আমাদের দেশের সকলের পরিচিত একটি ফল হলেও এর সম্ভাবনাময় দিক সম্পর্কে অনেকেরই অজানা। পেয়ার গুনগত মান আপেলের থেকে কোন অংশে কম নয়। পেয়ারা কেবলমাত্র গরিবের ফল তাই নয়। পেয়ারা এবং পেয়ারা পাতার রয়েছে বিচিত্র ঔষধি গুন। পেয়ারার পুষ্টি ও ঔষধি গুন প্রতি ১০০ ভাগ পেয়ারা আছে ১৪.৫ ভাগ কার্বহাইড্রেট ১.৫ ভাগ প্রোটিন ০.২ ভাগ ফ্যাট ০.৮ ভাগ খনিজ পদার্থ ০.০৪ ভাগ ফসফরাস ০.০১ বাগ ক্যালসিয়াম ১.০ ভাগ লৌহ ও ভিটামিন বি-১ বি-২ ও সি। প্রতিকেজি ফলের মধ্যে ৬৬০ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। এছাড়া পেয়ারা গাছের ছালের ক্কাথ ছোটদের উদরাময় রোগে ব্যবহার করা হয়। পেয়ারা পাতারও রয়েছে বিশেষ গুন। তাই পেয়ারা পাতা প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। পেয়ারা গাছের কোন কিছুই ফেলনা নয়। শুধু তার ব্যবহার ও উপযোগীতা জানলেই হয়। দেখা গেছে এক সময় যা ফেলনা ছিল পরবর্তী সময় তা মূল্যবান রফতানি পণ্যে পরিনত হয়েছে। এক্ষেত্রে পেয়ারা পাতা বিদেশে রফতানি করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে পেয়ারার চেয়ে পেয়ারা পাতার সম্ভাবনা বেশী বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশী পেয়ারা পাতার ব্যপক চাহিদা রয়েছে। পেয়ারা পাতা দিয়ে এক প্রকার চা তৈরী করেছে জাপান পেয়ারা পাতার চা মানব দেহের জন্য খুবই উপযোগী। বিশেষ করে যারা ডায়েবেটিক রোগী তারা স্বাচ্ছন্ধে পেয়ারা পাতার চা গ্রহন করতে পারে। এতে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এতে মানব দেহকে রি-ফ্রেশ করে দাঁত মজবুদ ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। পেয়ারা পাতার চায়ে কোন ধরণের কৃত্তিম ফ্লেভার বা রং ব্যবহার করা হয় না। তাই তা মানব দেহের জন্য কোন ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেয়ারা পাতার চা ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। বাংলাদেশে এখনও পেয়ারা পাতার চা উৎপাদন শুরু হয় নাই। তবে কয়েকটি কম্পানি পেয়ারা পাতা রফতানি শুরু করেছে। পুষ্টিগুণ
পেয়ারায় অনেক বেশি ভিটামিন সি ও এ রয়েছে।আপনারা জেনে অবাক হবেন একটি পেয়ারাতে সমান আকৃতির একটি কমলার ৪ গুন এবং একটি লেবুর ১০ গুন বেশি ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন বি২, কে, আঁশ, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ফসফরাস,আয়রন,কপার, ফোলেট ও ম্যাঙ্গানিজ এবং এতে কোন চর্বি নেই। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রন্ধন প্রক্রিয়ায় এই ফলটি একটি মিষ্টি ও সুস্বাদু উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পেয়ারার জুস একটি শক্তিদায়ক পানীয়।
স্বাস্থ্য উপকারিতা
১)মুখ গহ্বরের স্বাস্থ্য পরিচর্যায়– দাঁতে প্লাক জমা মুখের ভেতরের একটি বড় সমস্যা। পেয়ারা পাতা এন্টিপ্লাক বিশিষ্টের জন্য খুব কার্যকর। ভেষজবিদরা মুখ গহ্বরের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য কচি পেয়ারা পাতার পেস্ট ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। এই পাতার প্রদাহনাশক, বেদনাশক এবং জীবানুনাশক গুনাগুনের জন্য এটা মাড়ির প্রদাহ, মাড়ির ফোলা, মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে, দাঁতের ব্যাথা, মুখের ঘা সারাতে বেশ কার্যকর। পেয়ারা গাছের ডাল দাঁতের মাজন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। প্রতিদিন ১/২ টি পেয়ারা পাতা মুখে নিয়ে চিবালে ভালো ফল পাবেন। পেয়ারা পাতা দিয়ে তৈরি করতে পারেন মাউথওয়াশ, ৫/৬টি পেয়ারা পাতা পানিতে ফুটিয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা করে সেই পানি দিয়ে দিনে ১/২ বার কুলি করতে পারেন। ২)হৃদ স্বাস্থ্যের উন্নতিকরনে- ১৯৯৩ সালে “Journal of Human Hypertension” এ প্রকাশিত হয় যে নিয়মিত পেয়ারা খেলে রক্ত চাপ ও রক্তের লিপিড কমে কারন পেয়ারাতে উচ্চ পটাশিয়াম, ভিটামিন সি এবং দ্রবনীয় আঁশ থাকে। পটাশিয়াম নিয়মিত হৃদস্পন্দনের এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। নিয়মিত ভাবে লাইকোপিন সমৃদ্ধ গোলাপি পেয়ারা খেলে কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি কমায়। পেয়ারা পাতা ভালো করে শুকিয়ে চা বানিয়ে খেলে সম্পূর্ণ কোলেস্টেরল,খারাপ কোলেস্টেরল(LDL)এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায়। ৩)ডায়রিয়ার চিকিৎসায়- পেয়ারা পাতার চা ব্যাকটেরিয়ার কারনে সংঘটিত ডায়রিয়া প্রতিরোধ করে। কারণ এটার রস “Stephylococcus Aureus” নামক ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তাই ডায়রিয়া হলে দিনে কয়েকবার এই চা খেলে পায়খানার পরিমাণ, পানির মতো ভাব, পেট ব্যাথা কমিয়ে দ্রুত সুস্থ করে তুলবে। পেয়ারার এন্টি ব্যাকটেরিয়াল গুনাগুনের জন্য হজম ক্রিয়া ভালো হয়, এটা ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণুর বৃদ্ধিতে বাধা দেয় এবং এর আঁশ হজম ও নিঃসরণকে উন্নত করে। ৪)ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে- অনেকবছর ধরে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় চীনা ঔষধে পেয়ারা ব্যবহৃত হয়ে আসছে।১৯৮৩ সালে “The American journal of Chinese medicine”এ প্রকাশিত হয় যে পেয়ারার রসের হাইপোগ্লাইসেমিক গুনের প্রভাব ডায়াবেটিস মেলাইটাসের চিকিৎসায় খুবই কার্যকর। উচ্চআঁশ ও নিম্নগ্লাইসেমিক ইনডেক্সের পেয়ারা রক্তের সুগারের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া যারা ডায়াবেটিসের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে পেয়ারা পাতার চা ও খেতে পারেন। কচি পেয়ারা পাতা শুকিয়ে মিহি গুঁড়ো করে ১ কাপ গরম পানিতে ১ চা চামচ দিয়ে ৫ মিনিট ঢেকে রেখে তারপর ছেঁকে নিয়ে পান করতে পারেন প্রতিদিন। ৫)দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে- উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি সমৃদ্ধ পেয়ারা দেহকে ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশিসহ অসংখ্য রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিদিন ১টি পেয়ারা বা এর তৈরি সালাদ, স্মোদি বা পেয়ারা পাতার চা বানিয়ে খেতে পারেন। ৬)ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়- পেয়ারাতে থাকা বেশ কিছু যৌগিক পদার্থ যেমন লাইকোপিন, ভিটামিন সি এবং বেশ কিছু পলিফেনল থাকাতে এর রয়েছে ক্যান্সার ও টিউমার বিরোধী গুনাগুন। এগুলো শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে যা মুক্ত র‍্যাডিকেলকে নিরপেক্ষ করে দেহকে রক্ষা করে। ২০১০ সালে প্রকাশিত “Nutrition & Cancer” জার্নালে গবেষক বলেন যে পেয়ারার রস প্রোস্টেট টিউমারের আকার ছোট করে এবং প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।এছাড়া নিয়মিতভাবে পেয়ারা খেলে বিভিন্ন ক্যান্সার ধরনের যেমন স্তন, মুখের, ত্বকের, পাকস্থলীর, অন্ত্রের এবং ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। ৭)দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে- পেয়ারাতে থাকা উচ্চ মাত্রার ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে, কর্নিয়াকে সুস্থ, স্বচ্ছ রাখতে ও চোখের কোষকে সুরক্ষিত রাখতে এবং রাতকানা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া এর ভিটামিন সি কৌশিক নালীকে উন্নত করে রেটিনাল কোষের সঠিক কার্যক্রমে সাহায্য করে। তাই খাবারের মাঝে কাঁচা পেয়ারা বা এর জুস রাখলে তা দৃষ্টিশক্তির জন্য ভালো। ৮)জ্ঞানশক্তিকে উদ্দীপিত করতে- পেয়ারার দ্বারা মস্তিস্কের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে সুস্থ রাখা সম্ভব। এই সেরা খাবারটি জ্ঞানশক্তিকে উদ্দীপিত করার সাথে সাথে মনোযোগকে তীক্ষ্ণ করে। শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি থাকার কারনে এই ফলটি মানসিক ও মস্তিস্কের কার্যক্রমকে উন্নত করে। এছাড়া এতে থাকা ভিটামিন বি৩ ও বি৬ মস্তিস্কের রক্ত চলাচলকে উন্নত করতে সাহায্য করে।পেয়ারাতে থাকা পটাশিয়াম মস্তিস্কের তড়িৎ পরিবহনে সাহায্য করে যা চিন্তাশক্তি ও স্মরণশক্তিকে বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এই ফলটি রাখতে ভুলবেন না। ৯)সুস্থ ত্বকের জন্য- বিশেষ করে গোলাপি পেয়ারাতে রয়েছে শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট যা কোষকে নষ্ট করার জন্য দায়ী ফ্রী র‍্যাডিকেলকে নিরপেক্ষ করে। ফ্রী র‍্যাডিকেলের জন্য সাধারণত ত্বকে বয়সের চিহ্ন যেমন শুষ্ক, রুক্ষ, ভাঁজ ও অনুজ্জ্বলতার ছাপ পড়ে। ত্বকের নমনীয়তা ও ইলাস্ট্রিসিটি রক্ষা করে পেয়ারাতে থাকা ভিটামিন সি। এছাড়া পেয়ারা ও এর পাতার সংকোচন বৈশিষ্টের কারনে এটা আমাদের ত্বককে উন্নত করতে, সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির থেকে এবং ত্বকের সমস্যা যেমন ব্রণ ও ফুসকুড়ি থেকে রক্ষা করে। তাই সুন্দর ত্বক পেতে পেয়ারা খেতে পারেন অথবা কচি পাতা বা পেয়ারা পেস্ট করে মুখে মাখতে পারেন। ১০)থাইরয়েডের সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে- থাইরয়েড জন্য উপকারী কপারের খুব ভালো উৎস হচ্ছে পেয়ারা। এটি আমাদের দেহের খুব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি যা দেহের হরমোন ও অর্গান সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করে।আর কপার দেহের হরমোন উৎপাদন ও শোষণকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য এবং এর পটাশিয়াম ও শক্তিশালী প্রদাহনিরামক গুনাগুন থাইরয়েডের কাজকে উন্নত করতে সহায়তা করে।।তাই থাইরয়েড সংক্রান্ত সমস্যা দূর করার জন্য পেয়ারা ও পেয়ারা পাতাকে খাদ্য তালিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে নিতে হবে।এছাড়াও পেয়ারা দেহের শক্তি বৃদ্ধি ও ওজন কমানোর কাজকে সহজ করে দেয়।
জাপান, কোরিয়া, ইংল্যান্ড , যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ইতালি, ফ্রান্স ও গ্রীসে পেয়ারা পাতার চায়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশী। অন্যান্য দেশেও পেয়ারা পাতার চায়ে চাহিদা রয়েছে। তবে সব গাছের পেয়ারা পাতা দিয়ে চা তৈরী হয় না। শুধু অর্গানিক পদ্ধতিতে যে সব পেয়ারা গাছ চাষ হয় সে পাতাই চা তৈরির জন্য বিবেচিত হয়। আমাদের দেশের বরিশালের আটঘর কুড়িয়ানা, কুমিল¬া, ভালুকা, চট্টগ্রামের কাঞ্চন নগরে প্রচুর পেয়ারা চাষ হয়। এসব জায়গায় শুধু পেয়ারাকে কাজে লাগানো হয়। পাতা বা অন্যান্য অংশ ছাগলের খাবার কিংবা লাকরি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পেয়ারা পাতার এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে প্রচুর বৈদেশীক মুদ্রা অর্জন করার পাশাপাশি অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা য়ায়। প্রয়োজন উদ্ধোগ আর পৃষ্টপোষকতা। এবং উলে¬খিত এলাকায় পেয়ারা পাতার উপর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়া যেতে পারলে অচিরেই বাংলাদেশের অন্যান্য রফতানি যোগ্য কৃষি পণ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.