বৈরী জলবায়ু: দরকার দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ

0
(0)

মো. আহছান উল্লাহ

পৃথিবীর জলবায়ু নিয়ত পরিবর্তনশীল। জলবায়ু অতীতে পাল্টেছে, বর্তমানে পাল্টাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও পাল্টাবে। কিন্ত গত কয়েক দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি প্রায় সব শাখার বিজ্ঞানীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতুহল ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে এত আলোচনা ও বিতর্কের প্রধান কারণটি হলো বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মানুষের ভূমিকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে মানব অস্তিত্ব রক্ষার উপায় খুঁজে বের করার বিশ্বব্যাপী তাগিদ।

অতীতের জলবায়ু পরিবর্তনগুলো ছিল নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনা। সে পরিবর্তনের পিছনে মানুষের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল না। কিন্ত বর্তমানে জলবায়ুর যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে তার পেছনে মানুষের প্রকৃতিবৈরী কার্যকলাপের ভূমিকা আজ সর্বজনবিদিত। গত শতকের আশির দশকে এসে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন বিশ্বের উষ্ণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তার জন্য তাঁরা দায়ী করেছেন বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে ক্রমাগত শিল্পায়ন এবং বন ধ্বংসের কারণে গত কয়েক শতাব্দী ধরে বায়ুমণ্ডলে এসব গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে যা বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়ার জন্য দায়ী।

বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সাগরতলের উচ্চতা বাড়ছে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে, কোথাও বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে, আবার কোথাও অতিবৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে খরা ও মরুকরণ প্রবণতা বাড়ছে। জলবায়ুর এসব পরিবর্তনের ফলে কৃষিভিত্তিক অনেক অঞ্চলে ফসল উৎপাদন মার খাচ্ছে। এর ফলে মানুষের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হুমকির মধ্যে পড়ছে বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব। যত দিন যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের এসব প্রতিক্রিয়াও ততই বাড়বে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের ৪৬টি দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সবচেয়ে ক্ষতিকর মাত্রায় বাড়বে বলে তাঁরা আশংকা করছেন যার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় আমরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছি।

স্টকহোম থেকে কোপেনহেগেন

১৯৭২ সালে স্টকহোমে একটি আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলন হয়। বিষয় ছিল ওজোন স্তরের ক্ষয় এবং বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধি। ঐ বছরই আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংস্থা গঠিত হয় । এর ফলে শীর্ষ পর্যায়ের বিভিন্ন সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। অবশেষে ২০০৯ সালের শেষের দিকে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যাতে যোগ দেয় ১৯২টি দেশ। তবে এ সম্মেলন প্রত্যাশিত কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি।

কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসাবে বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। এ সম্মেলনে শিল্পোন্নত বা শিল্প উৎপাদননির্ভর দেশগুলোর কারণেই যে বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে সে বিষয়টি বারবারই এসেছে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়া দরিদ্র দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিও উঠে আসে। দুঃখের বিষয় এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে নিজেদের ভূমিকার কথা স্বীকার করতে চায় না, বা কখনও যদি বা করেও তবে তার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে চায় না। জলবায়ু ক্ষতিপূরণ আদায়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টিই এখন এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কৃষিকে বাঁচাতে হবে, কৃষকের জ্ঞান চুরি ঠেকাতে হবে

বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন এখনও অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। তাই জলবায়ুর যে কোনো পরিবর্তন আমাদের কৃষির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঋতুভিত্তিক এ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় তাই অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে যা শেষ পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তাকেই বিঘ্নিত করবে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ খাদ্য নিরাপত্তাকে চারটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে পারে: ১. খাদ্য উৎপাদন ও সহজপ্রাপ্যতা। ২. খাদ্য পাওয়ার অধিকার ৩. খাদ্যের সদ্ব্যব্যবহার, এবং ৪. খাদ্য সরবরাহ ব্যাবস্থা ও তার স্থায়িত্ব। বিষয়গুলো যথেষ্ট স্পষ্ট হওয়াতে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশের জন্য এসব প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব থেকে দেশের কৃষিকে বাঁচাতে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই পরিকল্পনার কাজে এখনই হাত দিতে হবে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা যা জরুরি ভিত্তিতে করা প্রয়োজন তার মধ্যে আছে,

  • জলবায়ুসহিষ্ণু বীজের ব্যবস্থা
  • মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন
  • পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা
  • প্রয়োজনে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সময় কিংবা স্থান পরিবর্তন করা
  • কৃষকের কাছে উন্নত যান্ত্রিক প্রযুক্তি পৌঁছানো
  • উপকূলীয় ভাঙন রোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ

এ কাজগুলো আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। আমাদের সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে যেন আমাদের দুর্যোগ ঝুঁকির সম্ভাবনাকে পুজিঁ করে বহুজাতিক কোম্পানি বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশকে হাইব্রিড ও জিএমও বীজের বাজারে পরিণত করতে না পারে। প্রয়োজনে হাইব্রিড আমাদের নিজেদের উদ্ভাবন করতে হবে। আবার বাংলাদেশের প্রজাতি বৈচিত্র্যের যে বিপুল বৈভব তাকে নষ্ট হতে দেওয়া চলবে না। সরকারকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭,, জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব নিরুপণ এবং আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তি ১৯৯২ (Convention on Biological Diversity 1992)-এর আলোকে বিভিন্ন কৃষি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিধান রাখতে হবে।

এছাড়া শত শত বছর ধরে গড়ে ওঠা এদেশের কৃষকের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার যাতে অন্য কোনো দেশ বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান চুরি করে নিতে না পারে এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য উপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষকের জ্ঞান সংরক্ষণের জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগঠনও তৈরী করা যেতে পারে।

সময়ক্ষেপণের অর্থ অপূরণীয় ক্ষতি

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারা পৃথিবী আজ ঝুঁকির সম্মুখীন এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপকেও তাই হতে হবে বৈশ্বিক মাত্রাতেই। এক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণে অপূরণীয় ক্ষতির শিকারই শুধু হতে হবে যার সবচেয়ে বড় মাশুল গুণতে হবে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র দেশগুলোকে। এজন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোকে গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করতে হবে এবং এ ক্ষতিপূরণের অর্থ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অত্যন্ত বিবেচনার সাথে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জনগণের উন্নতিকল্পে ব্যয় করতে হবে। শুধুমাত্র এ পথেই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো রক্ষা পেতে পারে।

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.