হিন্দু সম্পত্তি লীজ দেয়ায় এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা

0
(0)

সরদার মনিরুজ্জামান,গৌরনদী (বরিশাল)
উচ্চ আদালত ও সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মানছেন না বরিশালের উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঝুমুর বালা। উচ্চ আদালতের নিদের্শ অমান্য করে ওই উপজেলা নির্বাহী অফিসার উজিরপুর পৌর সদরের অসহায় সংখ্যালঘু দেবতোষ চন্দ’র পৈত্রিক ভিটে বাড়ির ৮০ শতক জমি সম্প্রতি এলাকার চিহ্নিত ভুমিদস্যুদের কাছে লিজ দিয়েছেন। এ ঘটনায় ওই এলাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এলাকার আতংকিত সংখ্যালঘুদের অভিযোগ ইউএনওর খামখেয়ালীপনার কারনে সেখানে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রশ্ন এ কারনে কোন রক্তপাত বা জীবনহানীর ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে ?
জানাগেছে, উজিরপুর পৌর সদরের জে,এল ৯২ নং উজিরপুর মৌজার ৪১৭ ও ৪১৮ নং এস.এ খতিয়ানের ৭৩৩ ও ৭৩৪ নং দাগের ১ একর ৬৯ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ভিটেবাড়ি পৈত্রিক রেকর্ডিয় সুত্রে দুই’শ বছরেরও অধিক সময় ধরে ভোগ দখল করে আসছেন সংখ্যালঘু দেবতোষ চন্দ ও তার পূর্ব পুরুষ গন। দেশ স্বাধীনের পর ওই সম্পত্তির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ভুমিদস্যুদের। তারা স্থানীয় ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের দ্বারা গোপনে ওই জমিকে ভূয়া ভিপি তালিকাভূক্ত দেখিয়ে ১৯৮৯ সালে জনৈক মাখম লালের নামে জমিটি ডিসিআর (লীজ) দেন। ঘটনা জানতে পেরে দেবতোষ চন্দ বাদি হয়ে ওই ডিসিআরের বিরুদ্ধে আদালতে একটি দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন, যার নং ৩৫/৮৯। ওই মামলার রায় হয় ১৯৯১ সালের ৩১ জুলাই। বিজ্ঞ বিচারক তখন বাদির পক্ষে রায় প্রদানসহ ওই জমিতে সরকারের প্রবেশের বিরুদ্ধে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এর পর ওই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ বিজ্ঞ জেলা জজ আদালতে ১৮৭/৯১ নং দেওয়ানী আপিল দায়ের করেন। আপিল মামলার দোতরফা শুনানী শেষে ১৯৯৩ সালের ১ আগস্ট বিজ্ঞ আদালত নিন্ম আদালতের দেয়া ৩৫/৮৯ নং মামলার রায় বহাল রেখে আপিল মামলাটি খারিজ করে দেন। পরবতীতে সরকার পক্ষ উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে ১৯৯৫ সালে মাহামান্য হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন মামলা দায়ের করেন। যার নং ৪৯ (কনঃ) ১৯৯৫। ওই মামলার দোতরফা শুনানী শেষে ১৯৯৭ সালের ২৯ মে মহামান্য হাইকোর্ট নিন্ম আদালতের দেয়া আদেশ বহাল রেখে মামলাটি খারিজ করে দেন। ফলে আইনগতভাবে ওই জমিতে সরকারের প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যায়। হাইকোর্টের ওই আদেশ অমান্য করে ২০১২ সালে এসে এলাকার ওই ভূমিদস্যুদের যোগসাজশে তৎকালীন উজিরপুর উপজেলা প্রশাসন হিন্দু পরিবারের পুরো সম্পত্তি প্রকাশিত “ক” তফসিলে গেজেটেভূক্ত করে তালিকা প্রকাশ করেন। এ ঘটনা জানতে পেরে সংখ্যালঘু দেবতোষ চন্দ তার সম্পত্তিকে “ক” তফসিলের গেজেট থেকে অবমুক্তির জন্য অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করেন যার নং ভিপি ১৪/১৪। বর্তমানে যার স্বাক্ষী চলছে। একই আদালত ওই মামলায় গত ২১ মে সরকারের বিরুদ্ধে একটি স্টাটাস্কো আদেশও জারি করেন। উচ্চ আদালতের এ সকল আদেশ অমান্য করে উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঝুমুর বালা গত ৪ জুলাই উপজেলার মাহার গ্রামের এনায়েত হোসেনের স্ত্রী রাশিদা বেগমের কাছ থেকে ১৩৯৭ বাংলা সাল থেকে ১৪২৪ সাল পর্যন্ত বকেয়া লিজমানি বাবদ ২১ হাজার ৭শত টাকা আদায় দেখিয়ে দেবতোষ চন্দ’র সম্পত্তির ৩৫ শতক, একইভাবে আব্দুল হাই হাওলাদারের পুত্র জাহিদুর রহমানের নামে সম পরিমান অর্থ আদায় দেখিয়ে ৩৫ শতক ও তরনী কান্তর পুত্র মাখন লালের কাছ থেকে ৬ হাজার ২শত টাকা আদায় দেখিয়ে ১০ শতকসহ উজিরপুর পৌর সদরের অশিতিপর বৃদ্ধ সংখ্যালঘু দেবতোষ চন্দ’র পৈত্রিক ভিটে বাড়ির সর্বমোট ৮০ শতক জমি চিহ্নিত ওই ভুমিদস্যুদের নামে লীজ (ডিসিআর) দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় নিয়োজিত একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনের একজন নারী নেত্রী সমকালকে জানান, আইন অমান্য করে ইউএনও ঝুমুর বালা ওই জমিতে ডিসিআর দিবেন এ রকম খবর পেয়ে আমি বিষটি সরকারের একজন যুগ্ন সচিব ও একজন উপ সচিবকে অবহিত করি এবং এ প্রকৃয়া বন্ধে তাদের সহযোগীতা চাই। ফলে আমাকে সামনে রেখে ওই দুই যুগ্ন ও উপ সচিব গত এক দেড় মাস পূর্বে সচিবালয় থেকে টেলিফোন করে ডিসিআর (লীজ) না দেয়ার জন্য ইউএনও ঝুমুর বালাকে নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশও উপেক্ষা করেন ঝুমুর বালা।
এলাকার আতঙ্কিত সংখ্যালঘুরা জানান, লীজ পাওয়ার পর থেকে ভুমিদস্যুরা যে কোন মূল্যে ওই জমি দখল করার জন্য সুযোগ খুজছেন। তারা যে কোন সময় অসুস্থ্য সংখ্যালঘু দেবতোষ চন্দ তার পরিবার পরিজনের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে তাদেরকে খুন-যখম করে অথবা তাড়িয়ে দিয়ে ওই বাড়িটির দখল নিতে পারে।
একটি গোপন সুত্র জানিয়েছে এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি। তিনি স্থানীয় আওয়ামীলীগের একটি সহযোগী সংগঠনের নেতা। বাড়িটি দখলে নেয়ার জন্য তার নেপথ্য ইন্ধনে ভূমি দস্যুরা বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানা প্রকার দেশীয় অ¯্র স¤্র মজুদ ও সন্ত্রাসী ভাড়া করছে। এহেন পরিস্থিতিতে চরম আতঙ্ক ও উৎকন্ঠার মধ্যদিয়ে দিন কাটছে অসহায় সংখ্যালঘু দেবতোষ চন্দ ও তার পরিবারের সদস্যদের।
মাইনরেটি রাইটস ফোরামের উজিরপুর উপজেলা সভাপতি ও আওয়ামীলীগ নেতা গৌরাঙ্গ লাল কর্মকার, সাধারন সম্পাদক শংকর মজুমদার, সাংগঠনিক সম্পাদক শৌভিক মিত্র, সাবেক ইউপি সদস্য ও নারী নেত্রী গৌরী রানী বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্বজল কর অভিযোগ করে বলেন উজিরপুরের ইউএনও ঝুমুর বালা দেশের প্রচলিত আইনকে অশ্রদ্ধা করে চলেছেন। তিনি বিভিন্ন ভাবে উপজেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনের উপর অন্যায়, অত্যাচার ও জুলুম করে আসছেন। নেতৃবৃন্দগন অনতি বিলম্বে দেবতোষ চন্দ’র বাড়ির লীজ (ডিসিআর) বাতিলেরও দাবি জানান।
অপর দিকে গত ১৪ জুলাই বরিশাল অশ্বিনী কুমার টাউন হলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত হন সরকারের প্রানী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ। এ সময় উজিরপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক সাধারন মানুষ ওই সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রতিমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেন। ঘটনা শুনে প্রতিমন্ত্রী দেবতোষ চন্দ’র জমির ডিসিআর (লীজ) দ্রুত বাতিল করে বিষয়টি সমাধানের জন্য বরিশাল জেলা প্রসাশককে নির্দেশ দেন। জেলা প্রশাসক প্রকাশ্য সভায় লিজ বাতিল পূর্বক বিষয়টি সমানের প্রতিশ্রুতি দেন। অথচ গত ৪ দিনেও এর কোন সুরাহা পাননি অসহায় দেবতোষ চন্দ।
আদালত অবমাননার অভিযোগ অস্বীকার করে উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঝুমুর বালা সমকালকে বলেন, ওই সম্পত্তি ভিপি গেজেটভুক্ত সরকারি সম্পত্তি। সরকারের নির্দেশনা রয়েছে ভিপি সম্পত্তি লীজ দেয়ার। দেবতোষ চন্দ’র দখলে থাকায় আমি চিঠি দিয়ে তাদেরকে লীজ নিতে বলেছি। তারা লিজ নেয়নি। তারা বলেছে ওই সম্পত্তি তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। আদালতের রায় আছে তাদের কাছে। আমি রায়ের কপি চাইলে তারা দেখাতে পারেনি।
ইউএনও ঝুমুর বালা মিথ্যা বলছেন দাবি করে কান্না জরিত কন্ঠে বৃদ্ধ দেবতোষ চন্দ সমকালকে বলেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অপুর্ব বাইন রন্টু ও সীমা রানী শীলসহ বেশ কয়েকজন গন্যমান্য ব্যাক্তির উপস্থিতিতে আমি ইউএনওর হাতে আদালতের রায়ের কপি পৌছে দিয়েছি। এরপর তিনি কপি পাওয়ার কথা অস্বীকার করায় রেজিষ্ট্রি ডাকে তার কাছে আদালতের রায়ের কপি পৌছিয়েছি। বংশ পরম্পরায় বিগত ২শত বছরেরও অধিক সময় ধরে আমার পূর্ব পুরুষগন এ জমি ভোগ করে আসছেন। সম্পত্তিতে আমার ঠাকুর দাদার, ঠাকুর দাদারও শ্মশান রয়েছে। বন্দোবস্তের কাগজ নেয়ার পর থেকে প্রভাবশালীরা আমার পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে পুরো পরিবারকে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন প্রকার হুমকি দিয়ে আসছে। আমি আমার পৈত্রিক সম্পত্তি রক্ষার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতা চাই।

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.