‘পদ্মাবতী’ নামক ভূয়া ইতিহাসভিত্তিক মুসলিম অবমাননাকর সিনেমা নিয়ে কিছু কথা

0
(0)

((মুহম্মাদ আহছান উল্লাহ)) = ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে শাসনক্ষমতা পোক্ত করার কাজে ব্যবহার করেছিল হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে, যার একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছিল জেমস টডের রচিত ‘অ্যানালস অফ রাজস্থান’ গ্রন্থটি। এর ভেতরে রাজপুত সম্প্রদায়ের কথিত গৌরবগাঁথা ও মুসলিমবিরোধী কাহিনীগুলোর ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি তো নেই-ই, এমনকি ‘রাজস্থান’ নামটিও ছিল টডের নিজের দেয়া। দিব্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত, ক্ষিতীশ সরকার রচিত ‘কর্নেল টডের রাজস্থান’ বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে-
//রাজস্থান নামে কোন দেশ বা রাজ্য ছিল না ভারতে, ছিল রাজপুতানা। ‘রাজস্থান’ বই লেখার মাধ্যমে এই নামকরণ করেছে টড নিজেই। স্বাধীন ভারতে রাজপুতানা এই নামেই আত্মপ্রকাশ করে। রাজপুতদের নিকট পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব টড। তার নামে মেবার অঞ্চলে এক গ্রামের নাম রাখা হয়েছে ‘টডগড়’। বলা হয় কর্ম ও পুনর্জন্মের প্রক্রিয়ায় টড প্রকৃতপক্ষে একজন রাজপুত।তবে ‘রাজস্থান’ প্রকাশের পরই প্রশ্ন উঠেছিল এর ঐতিহাসিকতা নিয়ে। প্রামাণ্য ইতিহাস নয়, লোকগান, ভাটের রচনা এসবের উপর ভিত্তি করে বইটি লেখা। অভিযোগ করা হয়েছিল, টডের এই বইটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পক্ষপাতমূলক। মার্কিন গবেষক জেমস ফ্রাইটাগ লিখেছে- সেখানে ইতিহাসের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অহঙ্কার।//অর্থাৎ এ যেন টড রচিত আরেক রামায়ণ, যার উপর ভিত্তি করে রামমন্দির মার্কা আরেক কল্পকাহিনী নিয়ে মেতেছে মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু সম্প্রদায়। ভারতে সঞ্জয় লীলা বানসালি প্রযোজিত ‘পদ্মাবতী’ নামক যে সিনেমার ট্রেলার সম্প্রতি ইউটিউবে ছাড়া হয়েছে, সেই সিনেমার কাহিনীও টড রচিত ভূয়া ইতিহাস থেকে নেয়া।পদ্মাবতী সিনেমার কল্পিত কাহিনীটি দিল্লীর শাসক আলাউদ্দীন খিলজী ও মেবারের রাওয়াল রতন সিং এর মধ্যকার যুদ্ধ নিয়ে। রাওয়াল রতন সিংয়ের স্ত্রীর নাম ‘পদ্মাবতী’। কাহিনীতে দেখানো হয়েছে, পদ্মাবতীকে অপহরণ করে ভোগ করার জন্য নাকি আলাউদ্দীন খিলজী মেবার আক্রমণ করেছিলেন। রাওয়াল রতন সিংয়ের পরাজয়ের পর পদ্মাবতী সতীদাহের নিয়ম মেনে আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মহুতি দেয়। অর্থাৎ পদ্মাবতী আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে, কিন্তু মুসলমান রাজার অধীনে যায়নি। এভাবেই এই কল্পকাহিনীর মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী সেন্টিমেন্ট চাঙ্গা করা হয়েছে।
এই ভূয়া কাহিনী নিয়েই হিন্দুরা প্রচুর কবিতা-গল্প রচনা করেছে, যার একটি কিনা বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকেও অন্তর্ভূক্ত ছিল। রঙ্গলালের লেখা ‘স্বাধীনতা বিনে কে বাঁচিতে চায়’ কবিতাটি আগের সিলেবাসে ছিল, যা নেয়া হয়েছিল রঙ্গলালের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’ বইতে এই ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ ও টডের কল্পকাহিনী নিয়ে বিষদ গবেষণামূলক আলোচনা রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন কোটেশন ও রেফারেন্সের মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে এই ‘পদ্মাবতী’ গল্পের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তিই নেই।যেমন ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগোর দৃষ্টিতে টডের ‘রাজস্থান’ এর কাহিনী `Too legendary for historical purpose’. ‘অক্সফোর্ড হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া’ এর রচয়িতা স্মিথের দৃষ্টিতে পদ্মাবতী সম্পর্কিত কাহিনীগুলো-“They cannot be regarded as sober history.”এই কল্পকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই মুসলিম শাসক আলাউদ্দীন খিলজীকে অবমাননা করা হয়েছে, গালকাটা ভিলেন চরিত্রে দেখানো হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এর প্রতিবাদে কোন মুসলমান কিছুই বলছে না! তারা চিন্তা করছে, আমরা খাই দাই ঘুমাই, আমাদের পূর্ববতী রাজা-রাজড়াদের নিয়ে হিন্দুরা যা খুশি তাই বলুক তাতে আমার কি আসে যায়?আসলে মুসলমানরা তো বোঝে না, একটি জাতির উপর গণহত্যা চালানোর আগে সেই জাতির বিরুদ্ধে বারংবার অপপ্রচার চালিয়ে পরিবেশ তৈরী করতে হয়। তারপর তাদের বুকে গুলি চালালেও কেউ কিছু মনে করে না। ভারতে মুসলমানদের উপর যে এতো বেশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, এর প্রধান একটি কারণ মুসলিমবিরোধী ভূয়া ইতিহাস নিয়ে তৈরী করা এসব সিনেমা ও নাটকসমূহ। ভারতের মুসলমান কিংবা আরাকানের রোহিঙ্গা, তারা তো তাদের ভূমিতে সম্মানপ্রাপ্ত জাতিই ছিল। ঐ অবস্থায় তাদেরকে হত্যা করাটা সম্ভবপর ছিল না। প্রথমে তাদের নিয়ে অবমাননাকর মিথ্যাচার করা হয়েছে, তাদেরকে একঘরে করা হয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষদেরকে নিচের ছবির মতো করে ভিলেন বানানো হয়েছে। এরপর তাদের গলায় ছুরি চালালেও কেউ কিছু মনে করে নি।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.