0
(0)

মো.আহছান উল্লাহ

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের জানা যে'কটি ছবি পাওয়া যায় তার একটি - ১৮৫৮ সালে তার মামলার পর তোলা- ছবি তুলেছিলেন 'ফটোগ্রাফার মি: শেফার্ড'

ছবির উৎস, The British Library.

ছবির ক্যাপশান, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের জানা যে’কটি ছবি পাওয়া যায় তার একটি – ১৮৫৮ সালে তার মামলার পর তোলা

এক শতাব্দীর ওপর শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে হঠাৎ করে তাঁর কবর আবিষ্কৃত হবার পর তাঁকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আবার নতুন করে আগ্রহ মাথা চাড়া দিয়েছে।

মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর নিজে একজন সুফি সাধক ছিলেন এবং ছিলেন ঊর্দু ভাষার প্রথিতযশা একজন কবি।

১৮৬২ সালে তদানীন্তন রেঙ্গুনে (আজকের ইয়াঙ্গন) একটা জরাজীর্ণ কাঠের বাড়িতে তিনি যখন শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তাঁর পাশে ছিলেন পরিবারের গুটিকয় সদস্য।

যে ব্রিটিশদের হাতে তিনি বন্দী ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর দিনই তারা বিখ্যাত শোয়েডাগন প্যাগোডার কাছে এক চত্বরে অজ্ঞাত এক কবরে তাঁকে দাফন করে।

পরাজিত, অপমানিত ও হতোদ্যম দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের জন্য সেটা ছিল ৩০০ বছরের গৌরবোজ্জ্বল মোগল সাম্রাজ্যের গৌরবহীন পতনের এক অধ্যায়।

তাঁর মোগল পূর্বপুরুষরা ৩০০ বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে- যার মধ্যে ছিল বর্তমানের ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং বাংলাদেশ।

তাঁর পূর্বপুরুষ আকবর বা ঔরঙ্গজেবের বর্ণময় শাসনকালের মত দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের শাসনকাল হয়ত তেমন গৌরবোজ্জ্বল ছিল না কিন্তু তাঁর ক্ষমতাকাল জড়িয়ে গিয়েছিল ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ সঙ্গে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনীতে বিশাল অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়।

ওই অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার পর সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার দায়ে মামলা করা হয়, তাঁকে বন্দী করা হয় ও ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমানের মিয়ানমারে (সাবেক বার্মায়) তাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয়।

বন্দী অবস্থায় ১৮৬২ সালের ৭ই নভেম্বর ৮৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।

কিন্তু তাঁর কবিতাগুলো মরে নি। তিনি লিখতেন ‘জাফর’ ছদ্মনামে। জাফরের অর্থ বিজয়।

১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহ্ জাফরকে আটক করছেন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হডসন- ওই ঘটনার আঁকা চিত্র
ছবির ক্যাপশান, ১৮৫৭ সালে বাহাদুর শাহ্ জাফরকে আটক করছেন ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হডসন- ওই ঘটনার আঁকা চিত্র

১৭০০র শেষ নাগাদ বিশাল মোগল সাম্রাজ্য ছোট হয়ে আসে। ওই এলাকায় মোগলদের প্রতিপত্তিও কমতে থাকে। ১৮৩৭ সালে জাফর যখন সিংহাসনে বসেন তাঁর রাজ্য ছিল শুধু দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকা জুড়ে। কিন্তু তাঁর প্রজাদের কাছে তিনি সবসময়ই ছিলেন বাদশাহ্।

অন্যান্য মোগল সম্রাটদের মত তিনিও মঙ্গোলীয় শাসক চেঙ্গিস খান এবং তৈমুর লংএর প্রত্যক্ষ বংশধর ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটি শাসককুলের অবসান ঘটেছিল।

সমর্থকদের তাঁর কাছ থেকে দূরে রাখতে ব্রিটিশরা তাঁর কবর নাম-পরিচয়হীন রেখে দেয়।

তাঁর মুত্যুর খবর ভারতে পৌঁছয় দু সপ্তাহ পরে এবং সে খবর প্রায় লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়।

এরপর একশ’ বছরের ওপর, বাহাদুর শাহ্‌ জাফরের স্মৃতি মানুষের মন থেকে প্রায় মুছেই গিয়েছিল।

কিন্তু বিবিসির আনবারাসন এথিরাজন লিখছেন ১৯৯১ সাল আকস্মিকভাবে তাঁর কবর উদ্ধার হবার পর অবিভক্ত ভারতের কিংবদন্তী শেষ মোগল সম্রাট আবার ফিরে আসেন মানুষের স্মৃতিপটে।

১৯৮০র দশকে ভারতের একটি টেলিভিশনে ধারাবাহিক তৈরি হয় তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে। দিল্লি এবং করাচিতে তাঁর নামে রাস্তা আছে, ঢাকায় একটি পার্কের নামকরণ হয় তাঁর নামে।

ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পিল, যিনি ‘লাস্ট মুঘল’ বইটির লেখক, তিনি বিবিসিকে বলেছেন ”জাফর একজন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন।”

”ইসলামী শিল্পরীতিতে পারদর্শী, তুখোড় কবি, এবং সুফি পীর জাফর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে গভীর গুরুত্ব দিতেন।”

”জাফর কখনও নিজেকে বীর বা বিপ্লবী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, তাঁর ব্যক্তিত্বও সেধরনের ছিল না, কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষ সম্রাট আকবরের মত তিনিও ইসলামী সভ্যতার একজন আদর্শ প্রতীক ছিলেন, যে সময় ইসলামী সভ্যতা তার উৎকর্ষে পৌঁছেছিল এবং সেখানে পরমতসহিষ্ণুতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে,” মি: ডালরিম্পিল লিখেছেন তার বইতে।

জাফরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পেছনে অনেক ঐতিহাসিক বলেন বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তাঁর মিশ্র ধর্মের পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। তাঁর বাবা ছিলেন দ্বিতীয় আকবর শাহ্ আর মা ছিলেন হিন্দু রাজপুত রাজকুমারী লাল বাঈ।

line

১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহ

১৮৫৭য় অবিভক্ত ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লিতে লড়াইয়ের একটি দৃশ্য

ছবির উৎস, Getty Images

ছবির ক্যাপশান, ১৮৫৭য় অবিভক্ত ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের সময় দিল্লিতে লড়াইয়ের একটি দৃশ্য

  • ১০ই মে উত্তর ভারতের মেরাট শহরে ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দিল্লি, আগ্রা, লক্ষ্মৌ ও কানপুরে।
  • নতুন সংস্কার, আইন, পশ্চিমা মূল্যবোধ এবং খ্রিস্টান ধর্ম চাপিয়ে দেবার চেষ্টার প্রতিবাদে ছিল এই বিদ্রোহ।
  • এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন হাজার হাজার হিন্দু ও মুসলিম সৈন্য, যারা তদানীন্তন মোগল সম্রাট, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্‌ জাফরকে তাদের নেতা মেনে নিয়েছিলেন।
  • ব্রিটিশ জেনারেলরা তাদের বিদ্রোহ দমনে মোতায়েন করেছিলেন পাঞ্জাব থেকে শিখ সৈন্য এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে পাঠান সৈন্যদের। দিল্লির নিয়ন্ত্রণ তারা আবার নেন সেপ্টেম্বরে।
  • দু তরফেই নির্বিচার হত্যার অভিযোগ ছিল। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছিল। ব্রিটিশদের হাতে নিহত হয়েছিল হাজার হাজার বিদ্রোহী ও তাদের সমর্থকরা।
  • ১৮৫৮ সালের জুলাই মাসে এই বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে। একই বছরে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বিলুপ্ত করে দেয়া হয় এবং ভারত ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনের আওতায় আসে।
line

ইয়াঙ্গনের নিরিবিলি এক রাস্তায় রয়েছে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের দরগা। ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম সবচেয়ে আবেগময় একটা সময়ের নীরব সাক্ষী বহন করছে বাহাদুর শাহ্ জাফরের এই সমাধিসৌধ।

ইয়াঙ্গনের দরগার ফটকে রয়েছে ভারতের শেষ মোগল সম্রাটের নাম
ছবির ক্যাপশান, ইয়াঙ্গনের দরগার ফটকে রয়েছে ভারতের শেষ মোগল সম্রাটের নাম

স্থানীয় মানুষ যদিও জানতেন স্থানীয় সেনা ক্যান্টনমেন্ট চত্বরের ভেতর কোথাও কবর দেওয়া হয়েছিল ভারতের শেষ মোগল সম্রাটকে, কিন্তু ১৯৯১ সালের আগে কেউ জানতে পারেনি কোনটি ছিল তাঁর কবর।

সেখানে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও কবর দেয়া হয়েছিল।

সেখানে একটি ড্রেন পাইপের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির সময় কিছু শ্রমিক একটি ইঁটের স্থাপনা দেখতে পায়, যেটি সাবেক সম্রাটের কবরের অংশ বলে জানা যায়। এরপর জনসাধারণের দানের অর্থ দিয়ে তা সংস্কার করা হয়।

জিনাত মহলের এটিই একমাত্র ছবি যেটি অক্ষত রয়েছে। ছবিটি সম্রাটের বন্দী অবস্থার সময় রেঙ্গুনে তুলেছিলেন জেনারেল ম্যাকমোহান

ছবির উৎস, Picture courtesy – The British Library

ছবির ক্যাপশান, তাঁর এক স্ত্রী জিনাত মহলের কবরও আছে এই সমাধিক্ষেত্রে। জিনাত মহলের এটিই একমাত্র ছবি যেটি অক্ষত রয়েছে। ছবিটি সম্রাটের বন্দী অবস্থার সময় রেঙ্গুনে তুলেছিলেন জেনারেল ম্যাকমোহান

ভারতে জাফরের পূর্বপুরুষদের যেসব জমকালো সমাধি রয়েছে তার তুলনায় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্‌ জাফরের এই সমাধিটি খুবই সাদামাটা। লোহার ফটকের গ্রিলে তাঁর নাম ও পরিচয় রয়েছে। একতলায় রয়েছে তাঁর একজন স্ত্রী জিনাত মহল এবং তাঁর নাতনি রৌনক জামানির কবর।

সমাধিগৃহে এর নিচে রয়েছে জাফরের কবর- তার ওপর ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এসে ছড়িয়ে দেন গোলাপ ও অন্য ফুলের পাপড়ি।

মাথায় লম্বা ঝাড়বাতি, দেয়ালে তাঁর প্রতিকৃতি। পাশে একটি মসজিদ।

ইয়াঙ্গনের মুসলিমদের কাছে এই দরগা খুবই পবিত্রস্থান।

”সর্ব স্তরের মানুষ আসেন এই দরগায়, কারণ তিনি ছিলেন একজন সুফি সাধক,” বলেন বাহাদুর শাহ্ জাফর দরগার পরিচালনা বোর্ডের হিসাবরক্ষক আল হ্বজ উ আই লুইন।

”মানুষ আসেন তাঁর কবরে প্রার্থনা করতে। তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে তারা দানধ্যান করেন।”

জাফরের কবর
ছবির ক্যাপশান, জাফরের কবরে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে গেছেন তাঁর ভক্তরা

ঊর্দু ভাষার তিনি ছিলেন বিখ্যাত একজন কবি। জীবন ও প্রেম নিয়ে তাঁর রচিত গজল খুবই বিখ্যাত এবং সেগুলো ইয়াঙ্গনের মুশায়েরাতে প্রায়ই গাওয়া হয়।

বন্দী অবস্থায় তাঁর কাগজ কলম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বলা হয় তিনি এসব গজল ও কবিতা লিখে গেছেন যে ঘরে তাঁকে আটক রাখা হয়েছিল সেই ঘরের দেয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে। তাঁর নিজেকে নিয়ে লেখা কয়েকটি কবিতা এই সমাধিতে খোদাই করা আছে।

সম্রাট হিসাবে বাহাদুর শাহ্‌ জাফর কোন সেনাদলের নেতৃত্ব দেননি। কিন্তু হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যরা তাঁকে নেতা মেনে ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করেছিল। ঐতিহাসিকরা বলেন মোগল শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে দুই ধর্মের হাজার হাজার মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

এই বছর – ২০১৭- সেই সিপাহী বিদ্রোহের ১৬০তম বার্ষিকী। কিন্তু ভারত বা ভারতের বাইরে কোথাও এই বিদ্রোহের বার্ষিকী উদযাপিত হয়নি।

ঐতিহাসিকরা বলছেন যখন জাতীয়তাবাদ আর মৌলবাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এমন একটা সময়ে জাফরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আদর্শ আরও বেশি করে সামনে আসা উচিত ছিল।

ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হয়ে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর হয়ত তাঁর রাজ্য, ক্ষমতা ও উপাধি হারিয়েছিলেন, কিন্তু একজন সুফি-সাধক, কবি ও ঐক্যের প্রতীক হিসাবে মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসন করে নিতে তিনি সফল হয়েছিলেন।

The Illustrated London News image of Zafar.

ছবির উৎস, Picture Courtesy – The British Library

ছবির ক্যাপশান, বাহাদুর শাহ জাফরের এই ছবিতে ধরা আছে মোগল সাম্রাজ্যের বর্ণময় ঐতিহ্য।

(সৌজন্যে বিবিসি)

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.