বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে পঞ্চাশ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আড়াই লাখ রোহিঙ্গার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন

0
(0)

এস এম রহামান হান্নান, স্টাফ রিপোর্টার
কয়েকদিনের জন্য রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কিছুটা কমে আসলেও নতুন করে কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে বেড়েই চলেছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মানুষের সে াত। এসব পয়েন্টে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। এরই মধ্যে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের মোট সংখ্যা ৫ লাখ ৮৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে। তাদের মধ্যে দুই লাখ ৫০ হাজার জনের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে, উখিয়া ও টেকলাফ ক্যাম্পে প্রথম ধাপে সাড়ে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে কলেরা টিকা খাওয়ানো হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছে বলে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন স্বীকার করেছেন।
মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢল কোনো ভাবেই থামছে না। থামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। মাঝে কয়েকদিন ধীরগতি ছিলো। এই সময়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইন বৌদ্ধদের সহায়তায় মংডু, বুচিডং, রাচিডং, টাউনশিপের আড়াইশোর বেশি গ্রাম রোহিঙ্গাশূন্য হয়েছে। গত সোমবার বিকেল থেকে নতুন করে বাংলাদেশ অভিমুখে ঢল নেমেছে এসব নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের। উখিয়া আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসতে থাকে।
গত তিনদিনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সাতটি পয়েন্ট দিয়ে হেঁটে উখিয়ার আঞ্জুমান উত্তর পাড়ার নাফ নদীর বেড়িবাঁধের ওপর অবস্থান করছে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। সেখানে তাদের মানবিক সাহায্য সহযোগিতা করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যর। এ ছাড়া আরো অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এপারে ঢুকতে মিয়ানমারের ওপারে কুয়াংসিবং, চাকমা কাটা সহ আশপাশে কয়েকটি পাহাড়ে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। কর্মহীনতা, খাদ্যের অভাব, ঘরে বন্দী করে রাখাসহ মৌলিক চাহিদা অপূর্ণতার কারণেই তারা পালিয়ে আসছেন বলে দাবি করেছে ।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই বুছিডং থানার মগনামা, কোয়াইনডং, জাদীপাড়া, লাওয়াডং গ্রামের বাসিন্দা।
আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা বুছিডং থানার কোয়াইডং গ্রামের মো. ইসলাম (৪৫) বলেন, রাখাইনের সহিংসতার পর থেকে তাদের গ্রাম্যবাজার বন্ধ রয়েছে। কোনো কাজ নেই, বাড়িতে খাদ্য নেই। পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকদিন ধরে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করেছি। সেনারা কোথাও দেখলে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে এক প্রকার অবরুদ্ধ হয়ে ছিলাম। প্রতি মুহূর্ত আতঙ্ক আর প্রাণের ভয়। তাই এপারে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।
মো. আলম নামে বুছিডং থানার লাউয়াডং গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, ১০ দিন ধরে পাহাড়ি পথ, মাঠ, খাল, বিল ও বিভিন্ন গ্রাম অতিক্রম করে সীমান্ত পাড়ি দিতে হয়েছে। একই গ্রামের বদর উদ্দিনের স্ত্রী রহিমা খাতুন বলেন, বিভীষিকাময় ও অবরুদ্ধ পরিবেশ থেকে উদ্ধার হয়ে খোলা আকাশে নিচে শান্তিতে অন্তত নিঃশ্বাস নিতে পারছি। অর্ধাহারে অনাহারে হাঁটতে হাঁটতে শরীর ক্লান্ত ব্যথা হয়ে গেছে।
মংডুর লামা পাড়ার মো. আলমের স্ত্রী মিজানা বেগম বলেন, স্বামী-স্ত্রী ও চার সন্তানসহ প্রায় এক সপ্তাহ পায়ে হেঁটে এপারের সীমান্তে পৌঁছেছেন। পথে তারা লতাপাতা খেয়েছেন। এপারে পার হওয়ার পর নাফ নদীর তীরে অবস্থান নিয়েছেন। পরে বাংলাদেশের বিজিবির সদস্যরা তাকে খাবার পানিসহ জরুরী ওষুধ সরবরাহ করেছেন।
এ বিষয়ে পালিয়ে আসা আবদুর রশিদ বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে চলছে অমানবিক নির্যাতন। জ্বালাও পোড়া বন্ধ করে রাখাইনের সেনারা এখন কৃত্রিমভাবে খাদ্য সংকট তৈরি করে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসতে বাধ্য করছে। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারের কোয়াংসিবং, চাকমা কাটাও তমারবিলের পাহাড়ি সীমান্তে আরো অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের কারো কারো কাছ থেকে ইতিমধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, ইয়াবা ট্যাবলেটসহ বেশ কিছু অবৈধ পণ্য থাকায় তাদের আটকিয়ে রাখা হয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
কক্সবাজার বিজিবির কমান্ডার কর্নেল আনিসুর রহমান বলেন, বিজিবির জিম্মায় প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে। তাদের সব ধরনের মানবিক সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, উখিয়ার সীমান্ত এলাকায় দিয়ে গত তিনদিনে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তারা সেখানেই নাফ নদীর তীরে বিজিবিসহ স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে রয়েছে। দ্রুত তাদের উখিয়ার কুতুপালংয়ে নিয়ে আসা হবে।
আড়াই লাখ রোহিঙ্গার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন: কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। গতকাল বুধবার কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জের অফিসে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ত্রাণমন্ত্রী এ তথ্য জানান।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আরো বলেন, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সব রোহিঙ্গার রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়ে গেলে অনুপ্রবেশকারীর সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে। ত্রাণমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, কোনো রোহিঙ্গা যেন না খেয়ে থাকে। আমরা তার নির্দেশ পালন করছি। সরকার নির্ধারিত কুতুপালং ক্যাম্পে ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে রাখা সম্ভব হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। মন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে এই ক্যাম্পে ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে স্থানান্তর করা হয়েছে। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৯ হাজার শৌচাগার (টয়লেট) নির্মাণ করা হয়েছে। চার হাজার টিউবওয়েলসহ সরকারের নেয়া সব প্রকল্প আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে বলেও তিনি জানান।
ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে কলেরা টিকা খাওয়ানো হয়েছে: উখিয়া ও টেকনাফ ক্যাম্পে প্রথম ধাপে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৪ জন রোহিঙ্গাকে কলেরা টিকা খাওয়ানো হয়েছে। ১০ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের এই টিকার আওতায় আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আবদুস সালাম ।
তিনি জানান. মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নতুন-পুরনো রোহিঙ্গাদের জন্য ৯ লাখ কলেরা ভ্যাকসিন আনা হয়েছে। দুই ধাপে করে এসব টিকা খাওয়ানোর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। প্রথম ধাপে গত ১০ অক্টোবর থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত ৬ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে কলেরা টিকা খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে টিকা খাওয়ানো হয়েছে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৫১৪ জনকে। এর মধ্যে পুরনো রোহিঙ্গাদেরও টিকা খাওয়ানো হয়েছে। এক বছরের ওপরের সবাইকে এই টিকার আওতায় আনা হয়েছে। আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফা কলেরা টিকা খাওয়ানো হবে। এর মধ্যে ১ বছর থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুরা আওতায় আসবে বলেও তিনি জানান।
সিভিল সার্জন জানান, গত দুই দিনে নতুন করে উখিয়ার পালংখালী পয়েন্ট দিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। তারা জিরো পয়েন্ট অবস্থান করছে। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকেই জ্বর, ডায়রিয়া ও গর্ভবতী। ওখানে গিয়ে তাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
সিভিল সার্জন আরো জানান, পালিয়ে আসা এতো রোহিঙ্গাদের মাঝে ডায়রিয়া ও কলেরা জীবানু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। সঠিক সময়ে তাদের চিকিৎসা দেয়ায় এখন কিছুটা শঙ্কামুক্ত। তবে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। যারা টিকা গ্রহণ করেছে বা চিকিৎসা নিয়েছে তাদের সাথে মিশে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। যার কারণে এখন যারা নতুন ঢুকছে তাদের ওখানে গিয়ে সরাসরি টিকা ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, টেকনাফের সাবরাং দিয়ে প্রতিদিন ঢুকছে রোহিঙ্গারা। ওখানেও চিকিৎসা ক্যাম্প করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য। উখিয়া ও টেকনাফে ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে ৫০টির বেশি চিকিৎসা ক্যাম্প করা হয়েছে। প্রতিদিন ২১০ টি মেডিকেল টিম কাজ করছে ক্যাম্পে। টিকা ছাড়া ইতিমধ্যে ২ লাখ ৬২ হাজার ৫৪৫ জন রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে। তৎমধ্যে সাড়ে ৬শ’ জন ডেলিভারি রোগী, ৫২ হাজার জ্বর ও সর্দি ও ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল। তাদের সফলভাবে সেবা দেয়া হয়েছে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.