নিজের এক খন্ড বসত ভিটায় কবরস্ত হতে চান যুদ্ধাহত বীরঙ্গনা মাতা নুরজাহান
আহছান উল্লাহ।
বরিশালের গৌরনদীর একজন যুদ্ধাহত বিরঙ্গনা মাতা নুর জাহান বেগম। আধুনিক সভ্যতার যুগে তার দুরাবস্থার কথা লিখব না, তবে তিনি অনেক সমস্যায় আছেন। করুন কাহিনী বলবনা,আসলে বীর মাতার মাথা গুজার মত এক চিলতে জমি বা বসত ঘর নাই। করোনা মহামারিতে কেউ খবর নেয়নি। ১২ হাজার টাকার ভাতায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন ঢাকায়। প্রতিবন্ধী ছেলেসহ ৬ সদস্য নিয়ে চলছে বীর মাতার অনেক কষ্টের জীবন।
বৃদ্ধ বয়সে মন্ত্রীপাড়া থেকে উপজেলা পর্যন্ত বহুবার অন্তিম আশাটুকু পুরনের জন্য দৌড় ঝাপ করে হেরে গেছেন। একটু ক্ষোভের সাথেই বীর-মাতা বললেন যদি পারো গৌরনদীতে আমার জন্য এখ খন্ড জমি আর একটা ঘরের ব্যাবস্থা কর। আর সেখানেই আমাকে কবরস্ত করিয়া রাখিও। ক্ষতবিক্ষত জীবনের শেষ মুহুর্তে এসে তার এ দাবী কি অন্যায়—?
ভাষা,স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব ও গনতন্ত্রের জন্য এ জাতির সংগ্রাম ছিল দীর্ঘদিনের। আমাদের এই দেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম ভোগলিক সীমারেখায় আনতে আমাদের দিতে হয়েছে জীবন,রক্ত আর মা বোনদের ইজ্জত। অসময়ে ঝড়ে গেছে অনেক মুল্যবান জীবন। শুধু একবার রক্ত দিয়ে ফিরে পাইনি আমরা স্বাধীন দেশ মাতৃকার এই সোনার হরিন। ফলে একটি যুদ্ধের শেষ হতে না হতেই জাতিকে পুনঃ পুন প্রস্ততি নিতে হয়েছে আরও একটি যুদ্ধের। এক আন্দোলনের শহীদের রক্ত না শুকাতেই আবার ভিজে গেছে বাংলাদেশের মাটি। এক মায়ের অশ্রæ মুছার আগেই আরেক মায়ের বাঁধভাঙ্গা চোখের জলে সিক্ত হয়েছে তার ¯েœহের আচল। এ কারনেই আমাদের প্রতিটি পরিবারই স্বজন হারানোর শোকে মুহ্যমান। তারপরও পরিবার-প্রিয়জনদের হারানোর অনন্ত বেদনায় আমরা যেমন ব্যাথিত আবার শহীদদের সন্তান,ভাই আত্মীয় স্বজন হিসেবে আমরা তেমনই গর্বিত।
এতদিন পরেও স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গিত জীবন্ত কিংবদন্তিদের অবহেলা সচেতন মহলের হৃদয়ে রক্তক্ষরন ঘটায়। রাজনীতির মতাদর্শ থাকলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি বীরদের ব্যাথায় সবাই ব্যাথাতুর হবে এটাই নতুন প্রজন্ম প্রত্যাসা করে ।
বীর মাতা নুরজাহান বেগম পরিবারের খুবই আদরের সন্তান ছিলেন। বাবা মৃত মোহাম্মদ ফকির,মা মৃত আনোয়ারা বেগম, গৌরনদী উপজেলার বাটাজোড় ইউনিয়নের বংকুরা গ্রামে পৈত্রিক নিবাস। স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহুর্তে চলছে সশস্ত্র সংগ্রাম। ১৬ বছরের কৈশোরের দুরন্তপনায় পা দিয়েছেন কৈশোরে। বান্দবীদের নিয়ে ছুটোছুটি খেলাধুলার বয়স। সে সময় যুদ্ধ না বুঝলেও কিছু একটা ঘটতেছে সেটা বুঝতেন। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনতেন।
বীর মাতা নুরজাহান বেগম বলেন, যতদুর মনে পরে তখন চৈত্র মাসের শেষ দিকে কয়েকজন বান্দবী নিয়ে বাড়ির পাশে বৌচি খেলছিলাম। হঠাত দেখী পাক সেনাদের সহায়তাকারী খাদেম মিলিটারীর নেতৃত্বে আনুমানিক ২০/২৫ জন পাক সেনা ও কয়েকজন রাজাকার আমাদের পারার নারায়ন মিস্ত্রির বাড়ির দিকে আসছে। আমরা ভয়ে সে সময় যে যেদিক পারছে পালাচ্ছে। আমি একটি জঙ্গলের পালিয়ে নিজেকে সামলানোর চেস্টা করছিলাম।
ঝোপের মধ্যে বসে দেখি হায়নার দল নারায়ন মিস্ত্রির বাড়িতে প্রবেশ করে। রমেশ বাবুর স্ত্রীকে টেনে হিচরে একটি ঝোপের কাছে নিয়ে নরপশুরা পৈশাচিক পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে। নারায়ন মিস্ত্রির বাড়ি ওরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সুধীর মিস্ত্রি দাদার বৃদ্ধ বাবাকে ওরা ব্যানেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করল। এরপর হায়নার দল আমাদের বাড়িটিও পুড়িয়ে দেয়। আমার বাবাকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে গুরতর জখম করে। তাদেও নির্যাতনের মাত্র এগারোদিন পরে বাবা মারাযান। আমি জঙ্গলের ভিতর থেকে সব দেখছি ভয়ে জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। নরপশুদের তান্ডব শেষ করে যাওয়ার পর আমি দৌড়ে রমেশ বাবুর স্ত্রীর কাছে যাই। সে রক্তাক্ত অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমিসহ আরো কয়েকজনে তাকে উদ্ধার করে পাশে আরেক বাড়িতে নিয়ে যাই। অনেক চেস্টার পর তার জ্ঞান ফিরে।
রক্ত পিপাসু হায়নাদের পৈশাচিকতার প্রতিবাদে বুকটা কেপে উঠলো। সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাবো। বাড়ির চাচাত ভাই মুক্তিযোদ্ধা আক্কেল ব্যাপারি ও আকবার বেপারির কাছে বললাম আমি আপনাদের সাথে যুদ্ধে যাবো। তারা পরামর্শ দিলো হোসনাবাদের নিজাম কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। আমি নিজাম ভাইর সাথে দেখা করে আমার আগ্রহের কথা জানালাম। নিজাম ভাই আমার বয়স কম হওয়ায় আমার বাবার কাছে নিয়ে আসলেন তার সম্মতির জন্য। কিন্ত বাবা সম্মতি দিলেন না।
আমার ভালো লাগছে না বিদ্রোহ মন নিয়ে একটা অসস্তি অবস্থায় পরলাম। মনের ভীতর হায়নাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। যে নির্মমতা চোখে দেখেছি কোন অবস্থায় যেন কাউকে কিছু বুঝাতে পারছিনা। প্রতিবেশী এক ভাইয়ের কাছে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করার অনুমতির কথা বলে বাবার নাম দিয়ে কমান্ডার নিজাম ভাইর কাছে একটি মিথ্যা চিঠি লিখালাম।
চিঠিটা নিয়ে নিজাম ভাইর কাছে গিয়ে বললাম বাবা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বলেছে,এই চিঠি বাবা দিয়েছে আপনার কাছে। চিঠি পেয়ে নিজাম ভাই বিশ্বাস করে আমাকে তার অধিনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ালেন। আমাকে তখন উপজেলার কসবা গ্রামের একটি মাঠে ট্রেনিং করার জন্য পাঠালেন। সেখানে আরো অনেক মেয়েদের পেয়েছি। তাদের মধ্যে যাদের নাম মনে পরে বরিশালের ছবি আপা,আনোয়ারাসহ আরো অনেকে। ছেলেদের মধ্যে বাটাজোড়ের মতলেব ভাই,গৌরনদীর কমান্ডার আলমগীর ভাইসহ অনেকেই ছিল। ট্রেনিং শেষ করার পর আমাকে কোন অস্ত্র দেয়া হলনা। আমাকে দায়ীত্ব দেয়া হল ইনরফরমার মুক্তিযোদ্ধাদের। বিভিন্ন ভ্যাসভূষা ধরে খবরাখবর আদান প্রাদান করতাম বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে।
যতদুর মনে পরে মাহিলাড়ার ভূতেরদিয়া গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা নুরু ভাই আমাকে একটি ত্রি-নট রাইফেল দেন। এই রাইফেল নিয়ে নুরু ভাইর নেতৃত্বে (বর্তমান উজিরপুর উপজেলার) জয়শ্রীর পাক সেনা ক্যাম্প আক্রমন করি। তখন তুমুল যুদ্ধ হয় যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এ সময় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সহিদ হন।
আমার ডান পায়ে গুলি লেগে গুরতর জখম লয়ে দৌড়াতে থাকি। কিন্তু পিছন থেকে এক পাক হায়না কিছু একটা দিয়ে আঘাত করলে মাটিতে লুটায়ে পরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। কিছু সময় পর জ্ঞান ফিরলে আমি দেখি গৌরনদী পাক সেনাদের ক্যাম্পে (বর্তমান সরকারী গৌরনদী কলেজ)। এখানে বসে আমাকে বিবস্ত্র করে আহত অবস্থায় নির্মম পাশবিক নির্যাতন করে। আমাকে মৃত্যু ভেবে পাশের এক পুকুরে ফেলে দেয়।
সেখান থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীর সহযোগীতায় আমাকে উদ্ধার করেন। স্থানীয় একটি মুক্তিযোদ্ধার ডেরায় আমার প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। কয়েকদিন পরে আমাকে গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসা হয়। সে সময়ও আমি অনেক অসুস্থ্য। ঘরবাড়ি পাক হায়নারা জ্বালিয়ে দেয়ায় প্রতিবেশী একজনের বাড়িতে আশ্রয় নেই।
এর কয়েকদিন পরেই ১৬ ডিসেম্ভর স্বাধীনতার বিজয় ঘোষনা করা হয়। তবে বরিশালের গৌরনদী মুলত হানাদার মুক্ত হয়েছিল ২২ ডিসেম্ভর। বর্তমান সরকারী গৌরনদী কলেজ মাঠে পাক হানাদাররা আত্মসর্ম্পন করে। এর কয়েকদিন পরে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধুর দেয়া ১ হাজার টাকা অনুদান পাই। আমি বীরঙ্গনা দেখে আমাকে গ্রামের মানুষ গ্রহন করতে চাইল না। রটি রুজির জন্য চলে গেলাম ঢাকায়।
ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ নুরু নামের একজনের সাথে। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। একটি পুত্র সন্তান আসে আমাদের সংসারে। কিন্তু দূর্ভাগ্য যেন পিছু ছারছে না তিন বছরের মাথায় স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান। ছেলেটিও শারীরিক প্রতিবন্ধী।
বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ ও দায়ির কাজ করে চলে সংসার। বর্তমানে শরীরে বিভিন্ন রোগে বাসা বাঁধায় সে কাজ করতে পারছি না। হার্ড ডায়াবেটিকস ও শরীরে চর্বি বেরে যাওয়ায় কর্মক্ষম হয়ে পরেছি। অনেক কষ্ট করে বিবিন্ন জনের দেয়া ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জোগার করে প্রতিবন্ধী ছেলেটির সাথে একজন লোক দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায় নামিয়ে দিয়েছি।
করোনার কারনে সে ব্যবসাও ভালো চলছে না। তিন বছর আগে থেকে মাসে ১২ হাজার টাকা করে ভাতা পাই তিন মাস পরপর। ঢাকায় বসবাস করায় বাসা ভারায়ই প্রায় টাকা চলে যায়। একটু জমি আর ঘরের জন্য মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর সুপারিশ নিয়ে ঢাকা থেকে উপজেলা পর্যায়ে অনেকবার দৌড়িয়েছি এখন হতাস। গত সেপ্টেম্ভর মাসে গৌরনদীতে গিয়ে এক কর্মকর্তার কাছে হাস্যরসের পাত্রও হয়েছি। বললেত কথা শেষ হবে না অনেক কষ্ঠ অনেক ব্যাথা বলার আর শোনার মানুষ আজো পাইনি। পৈত্রিক বা স্বামীর কোন সম্পদ পাইনি। তবে গৌরনদীতে শেষ জীবনে এক খন্ড ভিটা আর তার উপর একটু বসতি হলে ভালো হত। আপনারা সংবাদ লেখেন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন আমার জন্য এ ব্যবস্থাটুকু করেন। আমার মৃত্যুর পর যেন গৌরনদীর মাটিতে কবরস্ত হতে পারি বলে কান্নায় ভেংগে পরেন।
স্থানীয় শিক্ষক মোশারফ হোসেন বলেন বীর মাতাকে আমি ভালোভাবে চিনি। তার দাবীটুকু পুরনের জোর দাবী জানাচ্ছি কতৃপক্ষের কাছে।
গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল এর সাবেক সহকারি কমান্ডার দপ্তর ও পাঠাগার সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্জ খান সামচুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক সহকারি কমান্ডার ক্রিড়া সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সবুজ জানান ভাতা উত্তোলনের সময় নুরজাহানের সাথে দেখা হয় কথাও হয়। সে ভালো নেই আমরাও তার অন্তিম সময়ের আশাটুকু পুরনের জন্য কতৃপক্ষের কাছে দাবী জানাই।
গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস কালের কন্ঠকে বলেন,বীর মাতাকে আমার ছালাম দিবেন। সরকারি বিধি অনুযায়ী আমার কাজ থেকে সব রকম সহযোগীতা তিনি পাবেন।