নেপালে সক্রিয় অজস্র চক্র প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের শহরে এনে অনাথ সাজিয়ে বিদেশি অনুদান

0
(0)

বিদেশ খবর : হিমালয় জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্যন্ত গ্রামগুলির মানুষ যে কতটা কষ্ট করে জীবনযাপন করে, তা নিয়ে আলোচনা, লেখালেখি, ডকুমেন্টরি– এসব কম হয়নি। দারিদ্র্য একটি অভিশাপ তাঁদের জীবনে। আর এই চরম দারিদ্র্যের কারণেই নিরাপত্তার অভাব আরও প্রকট হয়ে ওঠে। মূলত মহিলা ও শিশুরা শিকার হয় নানা ফাঁদের। নিজেদের অজান্তেই অসৎ পথে চালিত হয় তারা। দারিদ্র্যের সুযোগে শিশুদের ব্যবহার করে চলে নানা কুকর্ম।

সম্প্রতি একটি ঘটনা সামনে আসার পরে জানা গেছে, অর্থের লোভে শিশুদের অনাথ সাজিয়ে টাকা তোলা হয় নেপাল-সহ হিমালয় পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। যদিও এ তথ্য যে একেবারে নতুন তা নয়, তবে নতুন করে সামনে এসেছে দেবীর ঘটনা। মর্মান্তিক সে ঘটনায় আরও উন্মুক্ত হয়েছে সে দেশের অন্ধকার এই দিকটি।

জানা গেছে, নেপালের এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ১০ বছরের ছোট্ট দেবীকে স্কুলে পড়াতে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এলাকার এক মহিলা। তিনি বেশ কিছু দিনের পরিচিত ছিলেন বলে সহজেই রাজি হয়ে যান দেবীর মা। তাই পরিবারের সম্মতিতেই দেবীকে নিজের গ্রাম থেকে কাঠমাণ্ডুতে নিয়ে যান ঐ মহিলা। দেবী বা তার মা কেউই জানতেন না, লেখাপড়া নয়। দেবীর জন্য অপেক্ষা করে আছে চরম দুঃখ আর হতাশার কাহিনি।

ঐ মহিলা কাঠমাণ্ডুতে একটি অবৈধ অনাথ আশ্রমের হাতে তুলে দেন দেবীকে। তাকে ‘অনাথ’ সাজানো হয় সেখানে। দেবীকে দেখিয়ে শুরু হয় অর্থ উপার্জন। পরে কয়েক জন সমাজকর্মী মিলে দেবীকে উদ্ধার করেন। তার পরেই পুলিশে জানাজানি হয় এই আশ্রমের কথা। লেখালেখি হয় স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে। সামনে আসে ঘটনাটি।

উদ্ধারকারী ওই সমাজসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে অঞ্জু পুন জানান দেবীর পরিবারকে বোকা বানিয়েই তাকে এই অবৈধ অনাথ আশ্রমে আনা হয়। কিন্তু এই আশ্রম রীতিমতো নরককুণ্ড ছিল দেবীর পক্ষে। জুটত না খাওয়া। শতচ্ছিন্ন পোশাক পরে থাকতে হতো। প্রতিবাদ করলেই শারীরিক নির্যাতন।

তথ্য বলছে, প্রতি বছর হাজার হাজার বিদেশি নেপালে অনাথদের সহায়তার জন্য অর্থ বা স্বেচ্ছাসেবী অনুদান পাঠায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সেদেশে পাঁচশোরও বেশি অনাথ আশ্রমে বসবাসকারী শিশুরা আদৌ অনাথ নয়। তাদের বাবা মা, পরিবার আছে। প্রত্যেককেই দরিদ্র পরিবার থেকে লোভ দেখিয়ে আশ্রমগুলিতে আনা হয়। অনেক ক্ষেত্রে জেনেশুনেও রাজি হয় পরিবারের। এটাই তাদের টাকা রোজগারের একটা উপায় যেন!

এভাবেই দেবীর মতো হাজার হাজার নেপালি শিশু এই চক্রের শিকার। দেখা গেছে, বেশিরভাগ দরিদ্র পরিবারই সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে মরিয়া কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য নেই। তাদেরকেই লক্ষ্যবস্তু বানায় অপরাধীরা। পড়াশোনার টোপ দেখিয়ে নিয়ে আসে শহরে। এই বাচ্চাগুলিকে দেখিয়ে বোকা বানানো হয় বিদেশী অনুদানকারীদেরও। তাদের থেকে বড় অনুদান আদায় করা হয় এভাবেই।

২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার আইনজীবী কেট ভ্যান ডুর নেপালে শিশুদের নিয়ে এই অন্যায় ব্যবসার অন্ধকার দিকের কথা সকলকে জানান সবার প্রথম। তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে কাঠমাণ্ডুতে কাজ করতে এসেছিলেন। সেখানেই একটি অনাথ আশ্রমে বেশ কিছু মেয়েকে দেখেন। দেখে ও কথা বলে তাঁর সন্দেহ হয়। তার পরেই তিনি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, সকলের মা, বাবা, পরিবার আছে।

কেট জানিয়েছিলেন, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। যাতে সহজে তাদের খোঁজা না যায়। শুধু তাই নয়, কম খাবার এবং অত্যাচার পুরোপুরি ভাবে অপুষ্টির শিকার করে তোলে তাদের। থেমে যায় বৃদ্ধি। প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করা পরিবার অনেক সময় খোঁজও পায় না, কী হল তাদের সন্তানের সঙ্গে। এভাবে বহু শিশুকে ব্যবসার হাতিয়ার করেছে নেপালের অসাধু চক্র।

কিন্তু সেই ২০০৬ থেকে আজ ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির যে খুব বদল হয়নি, তার প্রমাণ দেবীর ঘটনাটিই। প্রশাসন জানিয়েছে, সম্প্রতি লকডাউনের জেরে বহু মানুষ সমস্যায় পড়েছেন, অনটন আরও বেড়েছে। সেটাকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণির অপরাধীরা।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.