কোভিড-১৯ নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা জনসচেতনতা না হলে মারণ ঠেকানো দায়
সবুজবাংলা: চোখের সামনে জ্যান্ত মানুষটি ছটফট করছে। সজ্ঞানে লুটিয়ে পড়ছে যেখানে সেখানে। প্রাণ হারাচ্ছে প্রচন্ড কষ্টে। চোখের জলে কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে কাছের মানুষটি। আপন জন তাকে স্পর্শ করবে, সেই স্পর্ধা টুকুও নেই কারই। সত্যিই মানুষ আজ বড় অসহায়! আর্তনাদ হাহাকার বিশ্বে এখন এটাই ভয়াবহ এক ট্রাজেডি।
আধুনিক প্রযুক্তির একবিংশ শতাব্দীর মানুষ
এক অদৃশ্য গজবের কাছে পরাস্ত। কিসের এতো অহংকার? কিসের এতো ক্ষমতা? কিসের এতো গর্ব? সব কিছু নিরর্থক! বিশ্বব্যাপী মরণ হাওয়া বইছে। দাজ্জালের ফিতনায় লাশের মিছিল দেখেও নিরূপায় মর্ত্যভূমি। প্রচণ্ড ভয়ংকর এক রোগের প্রকোপে আধুনিক ডাইনামিক যুগেও সভ্যতা ছন্নছাড়া জীবনযাত্রা, বিচ্ছিন্ন সমাজ ব্যবস্থা। বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র যোগাযোগ। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মস্থান, অফিস কারখানা বন্ধ ।
মানুষের জীবন জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বহু পরিবার দুশ্চিন্তায় অতিষ্ঠ, সবার মনে আতংক ঢেউ আছড়ে পড়ছে? আতঙ্কের মূলে সর্বনাশা একটি অদৃশ্য ভাইরাস একেবারে আনকোরা ভাইরাস-করোনা। ১০০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভয়ংকর এক মহামারী ভাইরাস। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগ যা ফ্লু-র চাইতেও বহুগুণ ভয়াবহ। এটা অত্যন্ত সংক্রামক। এটি চীনের উহানে প্রথম ধরা পড়েছে। যা মানুষের ফুসফুসে মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। নিউমোনিয়া লক্ষণ নিয়ে কিছু মানুষকে আক্রমন করে। সেখান থেকে তার নমুনা সংগ্রহ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা( হু) গত ৩১ ডিসেম্বর করোনা ভাইরাসকে কোভিড-১৯ নামে চিহ্নিত করে। যেটা এখন মানুষের মনে ত্রাস তৈরি করছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণ মাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে।
করোনা আজ পুরা দুনিয়ার এক আতংকের নাম। এখনো পর্যন্ত যার কোন ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক বিজ্ঞানীরা তৈরি করে উঠতে পারেননি। এই বিশ্ব মহামারি রুখতে বিজ্ঞানীরা হিমসিম খাচ্ছে। রাতদিন দুটি চোখের পাতা আলাদা রেখে যথাসাধ্য পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সমাধান খুঁজতে মরিয়া। আর কিছু স্বঘোষিত ভন্ড বিজ্ঞানী ডাক্তারদের আর্টিকল, বক্তব্য ভিডিও গণমাধ্যমে তান্ডব পাকাচ্ছে। নিত্যনতুন চিন্তা ভাবনার ফতুয়া মানুষের মনকে আন্দোলিত করছে প্রতিনিয়ত।
কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক তা নিয়ে মানুষের মনে হাজার দ্বন্দ্ব ঘুরপাক খাচ্ছে। যা মানুষকে চরম ক্ষতির পথে নিয়ে যেতে পারে।
করোনা নিয়ে উদ্ভট অবৈজ্ঞানিক তথ্যাবলীও ভাইরাল হচ্ছে। এই নিয়ে কেউ বলছেন, এই খাবারগুলো খেলে করোনা আক্রমণ করতে পারবে না। আবার, কেউ বলছেন,করোনা থেকে বাঁচতে এই খাবারগুলো একদম খাবেন না। স্বভাবত সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত। এই ভাবেই বাজারে পোল্ট্রির দাম তলানিতে। ফলত মুরগী ব্যবসায়ীরা ভীষণ ক্ষতির মুখে। আবার মাছ ও মাটনের দাম হু হু করে বাড়ছে। আবার কেউ বলছেন। আদা-রসুন খেলে করোনা ভালো হয়ে যাবে। অথচ বাস্তব সত্য হল কোনও খাবারের সঙ্গেই করোনা হ্রাসবৃদ্ধির সম্পর্ক নেই। আবার কিছু অজ্ঞের ফল ফলাও করে বলছে, গোমূত্র পান করলে কি না করোনার সংক্রমণ ভালো হয়ে যাবে। কেউ কেউ তা পানও করছে । ইতিমধ্যে নোনা জলে ব্যবসাও শুরু হয়েছে। এরকম কোনও পথ্য বা ঔষধ করোনার চিকিৎসায় সুফলদায়ী বলে এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই। গোমূত্র পান থেকে শুরু করে নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক প্রতিষধক বা প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে বলে যে প্রচার হচ্ছে তা একেবারে আজগুবি। বিজ্ঞান বিরোধী ভূল সংবাদ ও ভুল তথ্য দিয়ে যারা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
করোনা মোকাবিলা করতে সারা পৃথিবী মরিয়া
এতবড় একটা বিপদ থেকে বাঁচাতে হলে- করোনা কি? করোনা কি ভাবে ছড়ায়? করোনা রোগের লক্ষণ কি? এর প্রতিরোধ কি ? তা মানুষকে জানতে হবে তা নাহলে এই বাইলোজিকাল যুদ্ধে সুস্থ ভাবে টিকে থাকা মুস্কিল।
COVID-19 সংক্রমন প্রথমে কোন পশু থেকে মানুষকে সংক্রমিত করে। সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি কাশি থেকে নির্গত জল কনা কোন ভাবে অন্য কোন ব্যক্তির চোখ মুখ বা নাকে প্রবেশ করলে তারও এই মরণব্যাধি রোগ হতে পারে। এটি রক্ত বাহিত বা বায়ুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে না। একটা মানুষের থেকে আরেকটা মানুষের কাছে চলে যায়। এটি কোন একটা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রতিদিন সংক্রমিত দেশের সংখ্যা হুড়হুর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারাবিশ্বে এই মুহূর্তে প্রায় ১৬২ টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস, এর ফলে বিশ্বব্যাপী প্রাণহানি হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। আর সংক্রমিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই ভাইরাস যেখানে প্রথম যখন ঢুকে তখন সেখানে প্রথম সপ্তাহে আক্রান্ত হয় ২-৩ জন দ্বিতীয় সপ্তাহে একশোর কাছাকাছি, তৃতীয় তা বেড়ে ৫০০-১০০০ হয়ে ছাড়িয়ে যায়, এই ভাবে এক মাসে ২০-৩০ হাজারেরও বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তবে এইটুকু রেহায় বা সান্ত্বনা যে করোনায় মৃত্যুহার মাত্র ২-৩ শতাংশ। তবুও ভয়ের কারন হলো যে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
করোনার রোগ থেকে বাঁচাতে আমাদের প্রাথমিক কাজ হবে-সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকানো। কি ভাবে আটকাবেন- সামাজিক মেলামেশা ও কমিউনিটিতে এই রোগ ছড়ানোর বড় কারণ তাই জনসমাগম থেকে দূরে থাকুন। এই রোগ আপনাকে না ছুঁলেও সাবধানে থাকুন। একান্ত দরকার না থাকলে সিনেমায় যাবেননা, মিউজিয়ামে যাবেননা, খেলার মাঠে যাবেননা। সরকারি নির্দেশিকা অনুসারে স্কুল কলেজ, সিনেমা হল, মেলা, উৎসব, শপিং মল যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করুন। শুধুমাত্র ইমার্জেন্সি কারন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেননা অপরিচিত, দূরাগত, বিশেষত বিদেশাগত ব্যক্তির থেকে দূরে থাকুন, শারীরিক ঘনিষ্ঠতা কম করুন।
আর দ্বিতীয় কাজ হল সংক্রামিত রোগীকে আলাদা করে রাখা খুব জরুরী। কি করে বুঝবেন যে আপনি এই রোগে আক্রান্ত?
অসম্ভব জ্বর, শ্বাস কষ্ট কাশিও ডুবে যাবার মত দমবন্ধ অনুভূতি হলে ভাববেন যে আপনি করোনা দ্বারা আক্রান্ত। আপনার করোনা হয়েছে কিনা একমাত্র ডাক্তারবাবুই সেটা বুঝতে পারবেন – কখন কি টেস্ট করতে হবে, কি ওষুধ খেতে হবে, ডাক্তারবাবু যা বলবেন মেনে চলুন l উনি একটা বিজ্ঞানসম্মত গাইডলাইন মেনে চিকিৎসা করছেন, মনে রাখবেন। কখন আপনাকে আইসোলেশনে যেতে হবে, কখন হোম quarantine এ থাকতে হবে – উনি যা বলবেন মেনে নিন l
তৃতীয় কাজ হল আক্রান্ত ব্যক্তির আধুনিক চিকিৎসার সর্বাধিক সুযোগ ব্যবহার করা উচিত। অকারণ সময় নষ্ট না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। মাস্ক ব্যবহার করুন বারবার হাত মুখ ধুয়ে নিন, সাবান বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন, হাঁচি কাশির সময় মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যান, অযথা অতিরিক্ত আতঙ্কিত হবেন না। নিজে সুস্থ থাকুন, সকলকে সুস্থ রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করুন। তবেই আমরা এই বিশ্ব মহামারী রুখে দিতে পারবো।
চিকিৎসায় আরোগ্যের সম্ভাবনায় বেশি, যেহেতু এই অসুখে মৃত্যুহার ২-৩শতাংশ। সংক্রামিত রোগীকে আলাদা করে রাখা খুব জরুরী। তবে কোন ভাবেই অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার দ্বারস্থ হবেনা না। অবাক লাগে যখন দেখি কিছু মানুষ নোনাজল নিয়ে আর কিছু মানুষ এটি গজব বলে হাসি ঠাট্টা-মস্করায় ব্যস্ত অথচ সারা পৃথিবী মোকাবিলা করতে মরিয়া। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন সচেতন নেই । এতবড় একটা বিপদকে আমরা বিপদ মনে করছি না গজব হিসেবে দেখছিনা। এক সময় যখন আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসবে তখন টের পাবো। হাসি ঠাট্টা-মস্করা ঘুঁচে যাবে। চীনকে ধরেছে ঠিক হয়েছে ওরা বৌদ্ধ ওরা মুসলিম বিরোধী। এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। গজব কিন্তু কোন ব্যক্তি বিশেষে আসে না। যখন আসে সবার জন্যই আসে।
করোনা এখন আপনার দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। হ্যাঁ ঠিকই বলছি ভারতে করোনা পজেটিভ। বায়োলজিকাল যুদ্ধের জন্য তৈরি হোন। তাই এই মুহূর্তে ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক মতপার্থক্য সব ভুলে সরকারের সমস্ত উপদেশ ও নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীদের সাহায্য নিতে হবে ও তাদেরকে সাহায্য করতে হবে। এই নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। করোনার মতো বিশ্ব মহামারি রুখতে শুধু বিজ্ঞানী, চিকিৎসকরাই শেষ কথা নয়। মানুষের সুচেতনাও এমন মহাযুদ্ধ প্রতিরোধের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্র।