বাচতে হলে জানতে হবে কোয়ারেন্টাইন নাকি আইসোলেশন !
আহছান উল্লাহ।।করোনাভাইরাস শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যেন বিশ্বজোড়া মৃত্যুমিছিলের একটা ছবি ফুটে উঠছে চোখের সামনে। আতঙ্ক আর করোনাভাইরাস যেন সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বজোড়া এই মহামারীর আবহে। এই শব্দটি সঙ্গে করে জুড়ে রেখেছে দু’টি শব্দকে। কোয়ারেন্টাইন আর আইসোলেশন। এই দু’টিই করোনা-আক্রান্ত বা করোনা-সন্দেহে চিহ্নিতদের গন্তব্য এখন। কিন্তু কোয়ারেন্টাইন মানে ঠিক কী? আইসোলেশনই বা কী? ঠিক কখন কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে, আর কখন আইসোলেশনে? এই দুইয়ের তফাতই বা কী? এই বিষয়গুলি হয়তো অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়।
গত বছর ডিসেম্বর মাসে চিনের হুবেই প্রদেশে শুরু হওয়া এই সংক্রমণ যখন এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন শোনা যাচ্ছিল, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের মানুষ কোয়ারেন্টাইনের আশ্রয় নিয়েছে। এই কোয়ারেন্টাইন শব্দটির অর্থ কী? আসলে এই শব্দের উৎপত্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেই উৎপত্তি জানলেই এই শব্দের অর্থ অনেকটা স্পষ্ট হবে।
কীভাবে এল কোয়ারেন্টাইন শব্দটি?
১৪ শতকে ইউরোপ জুড়ে মহামারীর আকার নেয় ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ। তখন বন্দর-শহর ভেনিসের তরফে একটি বিশেষ নিয়ম জারি করা হয়। বলা হয়, বন্দরে কোনও বিদেশি জাহাজ এলে, বা দেশের জাহাজ অন্য কোথাও বাণিজ্য করে ফিরলে, তীরে ভিড়িয়ে যাত্রীদের নামানোর আগে সেটাকে নোঙর করে সমুদ্রেই রেখে দিতে হবে চল্লিশ দিন। কারণ এই চল্লিশ দিন হচ্ছে অসুখের ইনকিউবেশন পিরিয়ড। কেউ সংক্রামিত হলে তা এই চল্লিশ দিনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখনই তাকে আলাদা করে ফেলা যাবে। তার আগে অবধি জাহাজ-ভরা প্রতিটি মানুষই সম্ভাব্য সংক্রামিত, যার থেকে রোগ ছড়াতে পারে।
তখন প্রযুক্তি ও চিকিৎসা এত উন্নত ছিল না, সহজে পরীক্ষা করে রোগ ধরারও উপায় ছিল না। ফলে কোনও রকম ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এই চল্লিশ দিনের অবরুদ্ধ দশাই রক্ষাকবচ ছিল। চল্লিশ সংখ্যাটিকে ইতালির ভাষায় বলা হয় ‘কোয়ারানতা’। আর সময় মানে ইতালিতে ‘তিনো’। ফলে এই অপেক্ষার সময়টিকে তারা বলতো কোয়ারান-তিনো। সেই থেকে এসেছে কোয়ারেন্টিন বা কোয়ারেন্টাইন শব্দটি।
অর্থাৎ, আপাত ভাবে সুস্থ থাকলেও সম্ভাব্য সংক্রামিত মনে হওয়া মানুষদের জন্যই এই কোয়ারেন্টাইন ব্যাপারটি প্রযোজ্য। যাঁরা বাইরে থেকে দেখতে সুস্থ মনে হয়, কিন্তু তাঁরা সুস্থ হতেও পারেন আবার নাও হতে পারেন, তাঁদের মধ্যে হয়তো জীবাণু আছে কিন্তু এখনও কোনও ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়নি– এমন ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।
বন্দি শুধু নয়, বিচ্ছিন্নও করে আইসোলেশন
কোয়ারেন্টাইন বিচ্ছিন্ন ও বন্দিদশা হলেও, তা কিন্তু আইসোলেশন নয়। আইসোলেশন হচ্ছে সেই অবস্থা, যখন কারও মধ্যে জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত ভাবে ধরা পড়বে। অথবা ধরা না পড়লেও উপসর্গ থাকবে এবং পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তখনই তাকে শুধু বন্দি থাকার নিদান দিলে হবে না, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। সেই অবস্থার নামই আইসোলেশন।সংক্ষেপে বলা যায়, আইসোলেশন হচ্ছে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য আর কোয়ারেন্টাইন হচ্ছে সুস্থ বা আপাত-সুস্থ ব্যক্তিদের জন্য। কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় কারও উপসর্গ বা অসুস্থতা দেখা দিলেই আইসোলেশনে নিয়ে গিয়ে তাঁর চিকিৎসা ও পরীক্ষা করাতে হবে।
সম্ভাবনায় কোয়ারেন্টাইন, অসুস্থতায় আইসোলেশন
কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকার সময়কাল নির্ভর করে, সংশ্লিষ্ট রোগের জীবাণুর সুপ্তকাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড কত দিন, সেটার উপর। যেমন, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে, এই ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড হচ্ছে অন্তত ১৪ দিন। অর্থাৎ যদি কারও শরীরে জীবাণু সংক্রমণ থাকে, তাহলে ১৪ দিন পর্যন্ত কোয়ারেন্টাইন করে রাখলে উপসর্গ দেখা দেবে বা অসুখ ধরা পড়বে। যদিও সম্প্রতি হু জানিয়েছে, করোনাভাইরাস অনেক ক্ষেত্রে ২৭ দিন পর্যন্ত সময় নিচ্ছে আত্মপ্রকাশ করার।
কোয়ারেন্টাইন একটা নির্দিষ্ট সময়কালের হলেও, কোনও সংক্রামিত ব্যক্তি বা অসুস্থ রোগীকে আইসোলেশনে কতদিন রাখা হবে তার কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। যত দিন পর্যন্ত তার চিকিৎসা চলবে, যতদিন না সে সুস্থ হয়ে ওঠে, ততদিনই তাকে আইসোলেশনে রাখতে হবে। ভাইরাসটি যদি বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন হাঁচি, কাশি, থুতু বা মল-মূত্র ত্যাগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে এই আইসোলেশন পুরোপুরি সেরে না ওঠা পর্যন্তই জরুরি। সেরে ওঠার পরে আবারও পরীক্ষা করে রোগ নির্মূল হওয়ার প্রমাণ মিললে তবেই আইসোলেশন সম্পূর্ণ হয়েছে বলা যেতে পারে।
কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন কোথায় করা হয়?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইসোলেশন হাসপাতালে করতে হবে, যেখানে চিকিৎসার সম্পূর্ণ পরিকাঠামো রয়েছে। কারণ আইসোলেশন মানে হল রোগীকে বিচ্ছিন্ন রেখে চিকিৎসা দেওয়া। তবে অনেক সময় এমনও হয়, অসুস্থ কোনও রোগী বাড়িতেই রয়েছেন, চিকিৎসা চলছে তাঁর। অথচ সংক্রামক হওয়ার কারণে বাড়ির কাউকে রোগীর কাছে যেতে বারণ করা হয়। এটাও এক ধরনের আইসোলেশন।
কোয়ারেন্টাইন অবশ্য অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। রোগটির গুরুত্ব, আক্রান্ত কোন স্তরে রয়েছে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, অবস্থান– এসব অনুযায়ী কোয়ারেন্টাইন কোথায় করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেমন ধরা যাক, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে, কেউ যদি বাইরের কোনও দেশ থেকে ভারতে আসে, তাহলে তাকে আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সরকারের ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টাইন করা উচিত। একে বলা হয় নিয়ন্ত্রিত কোয়ারেন্টাইন। এখানে থাকার সময়ে উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবে সরকারই
এ ছাড়া হতে পারে স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টাইন হওয়া। এ ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের কোনও জায়গায়, ঘরের ভিতরে আলাদা হয়ে থাকা যেতে পারে। হয়তো কোনও অসুস্থতা নেই, কিন্তু কোনও উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
নজরদারি জরুরি
চিকিৎসকরা বলছেন, যে কোনও সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই তা ঠেকাতে হলে প্রথম থেকেই সন্দেহভাজনদের খুব কড়াকড়ি ভাবে নিয়ন্ত্রিত কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। যদি তারা অসুস্থ হয় তাহলে আইসোলেশনে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। এটা করতে হবে খুব কড়া হাতে, প্রখর নজরদারির সঙ্গে। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এমনটা খুব জরুরি। সেই কারণেই প্রথম থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশ দিচ্ছে, প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে না বেরোতে।
গণ-কোয়ারেন্টাইনের বিপদ
তবে এই কোয়ারেন্টাইনে যদি একসঙ্গে অনেকেকে থাকতে হয়, অর্থাৎ গণ-কোয়ারেন্টাইন করা হয়, তাহলে করোনাভাইরাসের মতো মারাত্মক সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে তা তেমন সুবিধাজনক হয় না। প্রত্যেকে আলাদা থাকলে কারও মধ্যে উপসর্গ দেখা দিলেও সে সুস্থ কাউকে সংক্রামিত করতে পারে না। কিন্তু একসঙ্গে তা সম্ভব নয়। এর জ্বলন্ত উদাহরণ জাপানের উপকূলে থাকা ডায়মন্ড প্রিন্সেস নামের সেই জাহাজটি। জাহাজটিতে প্রথমে এক জন আক্রান্ত হন। তাঁর থেকে আরও অন্যেরা সংক্রামিত হয়ে গেছেন এমন আশঙ্কা করে গোটা জাহাজটিকেই গণ-কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। তার ফলে সমস্ত যাত্রীর শরীরেই ভাইরাসটি সংক্রামিত হয়ে যায়।
খুঁজতে হবে ইতিহাসও
শুধু তাই নয়, কোয়ারেন্টাইনে যাকে সম্ভাব্য ভেবে রাখা হচ্ছে, বা আইসোলেশনে যে ইতিমধ্যেই আছে, তার সংস্পর্শে যারা এসেছে গত কয়েক দিনে, অর্থাৎ রোগীর চিকিৎসা শুরুর পরে কিংবা তার মধ্যে উপসর্গ দেখা দেওয়ার সময়ে যারা তার আশপাশে ছিল, তাদেরও একটা তালিকা তৈরি করতে হয় রোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। মাথায় রাখতে হয়, এই তালিকায় থাকা মানুষদেরও আবার কোয়ারেন্টাইন কিংবা আইসোলেশনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে।
আইসোলেশনে সাবধান!
তবে আইসোলেশন মানেই বিপদ নয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে প্রায় ৮০ ভাগ রোগীই আইসোলেশনে থেকে নিজে নিজে ভাল হয়ে যায়, সামান্য সাপোর্টিভ কেয়ারে। কিন্তু যাঁরা তাঁর দেখাশোনা করবে, চিকিৎসা করবেন, তাঁদের সব ধরনের সতর্কতা ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া বাধ্যতামূলক।