একটি চন্দন গাছ আপনার জীবনের পেনশন
মোঃ আহছান উল্লাহ।
একটি চন্দন গাছ আপনার জীবনের পেনশন। একটি সম্ভাবনার কথা। একটি চন্দন গাছ বাড়ির আঙ্গিনা, কবরস্থান, শ্মশান কিংবা পরিত্যাক্ত জায়গায় রোপন করেন। নামমাত্র পরিচর্যায় ১০-১৫ বছরের ব্যবধানে পেনশনের মত আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাবে। বর্তমান বাজারে এক কেজি চন্দন কাঠের পাইকারী মূল্য প্রায় ২০ হাজার টাকা। আমাদের দেশে চন্দনের প্রচুর চাহিদা থাকলেও তা আমদানী নির্ভর। মানব কল্যানে শ্বেত চন্দনে রয়েছে অভূতপূর্ব গুন। যা আমাদের অনেকেরই অজানা। পরিকল্পিত চাষ করলে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে তেমনী হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এটি একটি প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারি দুর্লভ ভেষজ উদ্ভিদ।
সাধারণত তিন প্রকারের চন্দনের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে দুই প্রকারের চন্দনের অস্তিত্ব¡ পাওয়া যায়। তিন প্রকার চন্দন হল সাদা চন্দন বা শ্বেতচন্দন, রক্ত চন্দন বা লাল চন্দন,পিত চন্দন। তবে পিত চন্দনের কথা শোনা গেলেও এর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। শ্বেত এবং রক্ত চন্দন দুটিই ঔষধ ও প্রসাধনী শিল্পে ব্যবহার হয়। এর মধ্যে শ্বেতচন্দন এর মূল্য বেশী। শ্বেত চন্দন এর বোটানিকাল নাম সান্টালুম এ্যালবাম (ংধহঃধষঁস ধষনঁস)। জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কাটিং পদ্দতিতে চাড়া করার উপযুক্ত সময়। তবে পরিপক্ষ চাড়া বছরের যে কোন সময় রোপন করা যায়। চাড়া রোপনের ক্ষেত্রে একটু উচু জায়গা নির্ধারন করতে হবে। চন্দন সাধারনত একটু সৌখিন ও ক্ষড়াসহি¯œু গাছ। আমাদের দেশের সব এলাকাতে এর চাষ করা সম্ভব। শ্বেতচন্দন গাছের তেমন কোন রোগবালাই নেই। চন্দন কাঠের সুগন্ধ মানুষের কাছে আকর্ষনীয় হলেও পোকামাকড়ের কাছে আকর্ষনীয় নয়। শীতের শুরুতে শ্বেতচন্দন গাছের পাতা ঝড়ে যায়।
সাদা চন্দনের গাছ থেকে পাতন ব্যবস্থায় তেল নিস্কাশন করে প্রসাধনী,ঔষধ ও দামী আতর শিল্পে ব্যবহার করা হয়। শ্বেতচন্দন আমাদের কাছে সুগন্ধি কাঠ হিসেবে পরিচিত হলেও চন্দন কাঠের নির্যাস সাবান, পাউডার, আতর, ক্রিম, দাত মাজার পেষ্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আধুনিক ভেষজ শাস্ত্রে শ্বেতচন্দন বহু রোগের জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমন অতিরিক্ত রক্তচাঁপ, ব্রঙ্কাইটিস এছাড়া পেনিসিলিন আবিস্কারের বহু আগেই ভেষজ চিকিৎসকরা গনোরিয়া রোগের জন্য শ্বেতচন্দন ব্যবহার করেছেন। তখন চন্দনের তেলের সংগে অন্য দু’একটি ভেষজ মিশিয়ে ঔষধ বানানো হত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সর্বত্রই এটি গনোরিয়ার ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হত। এছাড়া খাদ্য হজম, ডায়রীয়া, আমাশয়, ঘামাচি, বসন্ত, হিক্কা সহ বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে চন্দনের বিভিন্ন ব্যবহার হয়েছে বর্তমানেও হইতেছে। রুপচর্চায় শ্বেত চন্দন ব্যবহারে যাদুকরি উপকার পাওয়া যায়।
সম্ভাবনাময় এ গাছের ব্যপক সম্প্রসারণ করা হলে প্রসাধন ও ঔষধ শিল্পের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আমাদের দেশে শ্বেতচন্দন কাঠের প্রচুর চাহিদা থাকলেও গাছটি আমাদের দেশে আমদানী নির্ভর। তাই একজন মানুষ এক একটি চন্দন গাছ রোপন করে ১০-১৫ বছর পরে যেমন পেনশনের মত আর্থিক সুবিধা পেতে পারেন। পাশাপাশি আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে পরিকল্পিত চাষ করে বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মূদ্রা আয় করা যায়।
কৃষিবিদ খলিলুর রহমান জানান আমাদের দেশে অনেকে আগর গাছকেও চন্দন বলে । সাধারনত অনেক নার্সারিতে আগর গাছকে চন্দন গাছ বলে চালানোর চেষ্টা করে থাকেন। আবার পেয়ারা কাঠে চন্দনের সুগন্ধি দিয়ে বাজাড়ে অহড়হ চন্দন কাট বলে বিক্রি হচ্ছে। তবে ভেষজ, জাতীয় কৃষির একটা উপখাত । সে উপখাতের একটি অংশ চন্দন গাছ,যা পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। এর অনেক মূল্য পরিকল্পিত এবং এর বানিজ্যিক চাষ করা উচিত। নাম মাত্র পরিচর্জায় এর চাষ করা যায়। আমাদের বাসা বাড়ির পরিত্যাক্ত জায়গায় এর চাষ করা যায়। ১৮/২২ ইঞ্চি টবে একটি চন্দন গাছ রোপন করা যায়। বছরে একবার একটু হালকা করে ডালপালা ছেটে দিলেই হয়। সর্বপরি এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত।
সুলতান আহম্মেদ নামের একজন অভিজ্ঞ কেমিষ্ট জানান বর্তমানে প্রসাধনী সামগ্রীর ব্রান্ড পন্য গুলোতে প্রচুর চন্দনকাট ব্যবহার করা হয়। আর এ কাট আমাদের দেশে অনেক উচ্চমূল্যে ক্রয় করতে হয়। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন আমি ঠিক জানিনা কি পরিমান চন্দন কাট আমদানী হয়। তবে আমাদের দেশে এর চাহিদা অনেক এবং ক্রমেই বাড়ছে। আর আমাদের দেশে বেশী চন্দন আসে ভারত,ইন্দোনেশীয়া থেকে।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ৬০ বছরের অভিজ্ঞ কবিরাজ আলতাফ হোসেন খান বলেন, শ্বেত চন্দনের অনেক উপকারিতা আছে ,বলে শেষ করা যাবে না। তবে বাজারে আসল শ্বেত চন্দন পাওয়া কঠিন। আমার বাস্তব জীবনে মেয়েলী সংক্রান্ত অনেক জটিল রোগে, অনুপনসহ শ্বেত চন্দন প্রয়োগ করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ভাবে ভালো ফল পেয়েছি। তবে বাজার থেকে আমরা যে চন্দনকাট ক্রয় করি তা প্রায়ই নকল, পেয়ারা কাঠে চন্দনের সুগন্ধি মেশানো যে কারনে ওই কাঠে কয়েকদিন পরে কোন সুগ্রান থাকেনা। যে কারনে আমি অনেক কষ্ঠ করে কয়েকটি চন্দন চাড়া রোপন করেছি তাতে আমার এখন বাহির থেকে কেনতে হয় না।
গৌরনদীর বেগম আমেনা খাতুন (বঙ্গবন্ধুর বোন) হোমিও পেথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডাঃ কে এম সাঈদ মাহমুদ বলেন, হোমীওর অনেক ঔষধ আছে যাতে চন্দনের ব্যবহার হয়। আর চন্দন ব্যবহৃত ঔষধগুলোর দামও একটু বেশী। আর চন্দন কাঠের দাম ক্রমেই বাড়ছে। এখন চন্দন যেমন ঔষধে ব্যবহার হচ্ছে তেমনী প্রসাধনী সামগ্রীতেও এর ব্যবহার বেড়ে গেছে।
আয়ুর্বেদ সাস্ত্রের পন্ডিত অধ্যক্ষ নিখিল রায় চৌধুরী বলেন স্বর্গে আরোহন কিংবা পুণ্য অর্জনের জন্য শ্বেতচন্দনের উপযোগিতার শেষ নেই। সুভাষিত চন্দন বাদে দেবী আরাধনার কথা চিন্তা করাই যায় না, তেমনি শ্বেতচন্দন বাদে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের কথাও ভাবা যায়না। সব চন্দন কাঠই উপকারী তবে শ্বেত চন্দন যেমন দামী তেমনী মানব স্বাস্থের জন্যও উপকারি অসাধারন একটি দুর্লভ ভেষজ। স্বাস্ত্রমতে বাড়ির আঙ্গিনায় চন্দন,নিম,কারি ও ননি গাছ থাকলে পুরো বড়ি সংক্রমন রোগ মুক্ত থাকে। আসলে অধিকাংশ মানুষ প্রকৃতি বিমূখ। বর্তমান প্রজন্মের এই কংক্রিটের জঞ্জালের ভীতর দিয়েই পরিকল্পিতভাবে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়াটাই বুত্তিমত্তার পরিচয় দেয়া হবে। কেননা সু-স্বাস্থ্য সুখের মূল।
কোরআন হাদিসের আলোকে বিশিষ্ঠ মুফাচ্ছের আলহাজ্ব মাওলানা হাফেজ কামরুল ইসলাম খান বলেন, মহান আল্লাহ গাছ পালার মধ্যে মানুষের কল্যানের জন্য অনেক উপকারি নেয়ামত দিয়েছেন। তবে চন্দন কাঠ সম্পর্কে পাক কালাম ও হাদিসের আলোকে যা বুঝা যায়। ছহি বোখারী শরীফ এর ৫২৯০ নং হাদিসে হযরত উম্মে কায়স বিনতে মেহসান (রাঃ) বলেছেন আমি নবী করিম (সাঃ) কে বলতে শুনেছি তোমরা হিন্ধি উদে ব্যবহার করবে। কেননা এতে সাত প্রকারের রোগের সেফা আছে। পাক কোরআনের সুরা মুনাফেকুনের তাফসিরে এর উল্লেখ আছে। বিজ্ঞ তাফসির কারক গন হিন্দি উদেকে শ্বেথ চন্দন বলেই মত প্রকাশ করেছেন। আপনারা দেখবেন আমাদের দেশে আগরবাতী/ধুপকাঠী জালানোর একটা প্রচলন আছে। আর আরবের পরিবার গুলো তাদের বাসস্থানে প্রচুর চন্দন কাট জালিয়ে ধোয়া দেয়। এর ধোয়া থুবই সুগন্ধি ছড়ায় যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।