জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলছে অপচয়

0
(0)

মুফতি তাজুল ইসলাম

জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলছে অপচয়

অপচয় শব্দটিকে আরবিতে ‘ইসরাফ’ বলা হয়। ইসরাফ অর্থ সীমা লঙ্ঘন। এর বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। অপচয় শব্দের সঙ্গে অর্থ-বিত্তের একটি সুতীক্ষ সম্পর্ক অনেকে স্থির করে নিয়েছে। ইমাম কুরতুবি (রহ.) লিখেছেন, কোনো কিছুতে সীমা লঙ্ঘন ও ভারসাম্যপূর্ণ সীমা অতিক্রম করাকে ‘ইসরাফ’ বলা হয়। (তাফসিরে কুরতুবি : ৪/২৩১)

আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) লিখেছেন, প্রতিটি কথা ও কাজে নির্ধারিত চৌহদ্দি অতিক্রম করাকে ‘ইসরাফ’ বলা হয়। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমা অতিক্রম বোঝাতে ইসরাফ শব্দটির ব্যবহার অধিক প্রসিদ্ধ। (ফতহুল বারি : ১০/২৫৩)

তাহলে আমরা দেখতে পাই, যেকোনো বিষয়েই অপচয় হতে পারে, সীমা অতিক্রম হতে পারে।

ইসলামী শরিয়ত মতে, জীবনের সব ক্ষেত্রে অনর্থক অপচয়, অপব্যয় ও সীমা লঙ্ঘন নিষিদ্ধ।

 

অপচয় বা সীমা অতিক্রমের বিভিন্ন পর্যায়

অপচয় বা সীমা অতিক্রমের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। এক. অপাত্রে খরচ করা। দুই. আল্লাহর অবাধ্যতায় অর্থ ব্যয় করা। তিন. বৈধ কাজে প্রয়োজন ও ভারসাম্যপূর্ণ সীমারেখা অতিক্রম করা। চার. হালালের সীমা ছেড়ে হারামকে গ্রহণ করা অথবা হারামকে হালাল করে নেওয়া। (মা’আরেফুল কোরআন : ৩/৫০৪)

অনেকে এ বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার যে তারা মনে করে, অপচয় বলা হয় অপব্যয়কে। অথচ কোরআন ও হাদিসের আলোকে জানা যায়, জীবনের সব শাখা-প্রশাখায় ন্যায্য পথ ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অতিক্রম করাকে ইসরাফ বা অপচয় বলা হয়। অপচয়ের এই পরিব্যাপ্তি সম্পর্কে অনেকের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই। ফলে বর্তমানে জীবনযাত্রা কঠিন থেকে কঠিন হয়ে পড়ছে।

খাবারে অপচয় : খাবারের ক্ষেত্রে অপচয় হলো, ক্ষুধা ও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাওয়া। হালালের সীমা অতিক্রম করে হারাম খাবার গ্রহণ করা। সব সময় খাবারের ধান্দায় থাকা। (মা’আরেফুল কোরআন : ৩/৫৪৬)

পোশাকে অপচয় : প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিধান করা, মাত্রাতিরিক্ত সাজসজ্জা গ্রহণ করা পোশাকের ‘ইসরাফ’। যদিও ব্যাপকভাবে অর্থাৎ সীমা লঙ্ঘন অর্থে বিবস্ত্র থাকা, পাপাচারীদের পোশাক পরিধান করা, নারী পুরুষের পোশাক এবং পুরুষ নারীর পোশাক পরিধান করা ইসরাফের অন্তর্ভুক্ত।

সময়ের অপচয় : সময়ের অপচয় হলো, আল্লাহর অবাধ্যতায় অনর্থক কাজে সময় নষ্ট করা। সফল মুমিনের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তারা (সফল মুমিন) অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা : মুুমিনুন, আয়াত : ৩)

পানি খরচে অপচয় : প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত করা, ব্যবহার করা হাদিসের ভাষ্য মতে ইসরাফ তথা অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। একবার সাদ (রা.) অজু করছিলেন। এমতাবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন। হঠাৎ তিনি বলেন, এই অপচয়ের কী অর্থ? সাদ (রা.) বলেন, অজুতেও কি অপচয় হয়? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হ্যাঁ, অজুর মধ্যেও অপচয় হয়, যদিও তুমি প্রবহমান নদীতে অজু করো। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫)

অর্থ ব্যয়ে অপচয় : অবৈধ কাজে অর্থ ব্যয় অথবা বৈধ কাজে প্রয়োজন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের বক্তব্য হলো, ‘তারা (রহমানের বান্দারা) যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না, বরং তারা এর মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে। (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৭)

প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষেত্রে অপচয় : ইসলাম উদারতা, মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতাকে পছন্দ করে। তবে অন্যায়, জুলুম ও অবিচারকে মোটেও প্রশ্রয় দেয় না। তাই কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে ইসলাম এ ক্ষেত্রে কিসাস বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রবর্তন করেছে। তবে এই বদলা নেওয়ার ক্ষেত্রেও ইসলাম ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দিয়েছে। সীমা লঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হত্যার বদলে হত্যা করার ক্ষেত্রেও তোমরা সীমা লঙ্ঘন কোরো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৩)

অন্যদিকে কারো কাছ থেকে বদলা বা প্রতিশোধ সম্পর্কে নীতি কী হবে, কোরআন বলছে, ‘যদি তোমরা শাস্তি দিতে চাও, তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দাও, যতখানি অন্যায় তোমাদের ওপর করা হয়েছে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৬)

কথার মধ্যে অপচয় : সাধারণ অর্থে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা কথার অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। তবে ব্যাপক অর্থে মিথ্যা বলা, গিবত করা, গালি দেওয়া, অন্যকে কষ্টদায়ক কথা বলা কথার অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত।

কাজের মধ্যে অপচয় : অনর্থক কাজ করা, পাপ কাজ করা কাজের অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন, আগের স্থিরচিত্তের অধিকারী নবীরা এই দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপ ও আমাদের কর্মে সীমা লঙ্ঘন তুমি ক্ষমা করো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৪৭)

 

অপচয়ের ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসের নিষেধাজ্ঞা

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য স্থানে অপচয় করতে নিষেধ করা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘পানাহার করো, অপচয় কোরো না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না, আর একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৯)

বিষয়টি হাদিস শরিফে এভাবে এসেছে, ‘পানাহার করো, সদকা করো আর পোশাক পরিধান করো, যতক্ষণ তা অপচয় ও অহংকার মিশ্রিত না হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৬০৫)

আল্লাহর দেওয়া সম্পদ অপচয় করা আল্লাহ তাআলা কিছুতেই পছন্দ করেন না। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের তিন বস্তু পছন্দ করেন আর তিন বস্তু অপছন্দ করেন। আল্লাহর পছন্দনীয় বস্তুগুলো হলো তাঁর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কাউকে অংশীদার না করা এবং সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ থাকা, বিচ্ছিন্ন না হওয়া। আর আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্তু তিনটি হলো অহেতুক কথা বলা, অহেতুক প্রশ্ন করা ও অনর্থক সম্পদ বিনষ্ট করা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৭১৫)

কোনো ব্যক্তি অপচয় বা অপব্যয় করে শয়তান কর্তৃক প্ররোচিত হয়ে, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এ জন্য পবিত্র কোরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৭)

আল্লামা বরকুভি (রহ.) বলেন, ‘শয়তানের ভাই শয়তানের মতোই। এই পৃথিবীতে শয়তানের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো নাম নেই। এ হিসেবে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই আখ্যায়িত করার চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো বিশেষণ নেই।’ (আত-ত্বরিকতুল মুহাম্মদিয়া, পৃষ্ঠা : ১০৩)  / কালের কণ্ঠ

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.