‘পঞ্চম খলিফা’ উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)

0
(0)

মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ

‘পঞ্চম খলিফা’ উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)

ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম হলেন উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)। খোদাভীতি, বিচক্ষণতা, সাহসিকতাসহ সাহাবাদের অনন্য গুণাবলির সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মাঝে। তাই অনেকে তাঁকে ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলে খোলাফায়ে রাশেদার মধ্যে গণ্য করেন।

উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.) ৬১ হিজরিতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুল আজিজ বিন হাকাম ছিলেন বনি উমাইয়ার শ্রেষ্ঠ গভর্নরদের অন্যতম। ২০ বছরেরও বেশি সময় মিসরের শাসক ছিলেন তিনি। বিয়ের আগে আবদুল আজিজ (রহ.) নিজের সহকারীকে বলেন, ‘আমার বৈধ সম্পদ থেকে আমার জন্য চার শ দিনার সংগ্রহ করো। আমি অত্যন্ত সৎ পরিবারের মেয়ে বিয়ে করব।’ অতঃপর তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর নাতনি উম্মে আসেম লায়লা বিনতে আসেমকে বিয়ে করেন। উম্মে আসেমের নানি ছিলেন ওই নারী, যে মায়ের নির্দেশ অমান্য করে গভীর রাতে দুধে পানি মিশ্রণ থেকে বিরত ছিলেন এবং আড়াল থেকে তা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)।

মদিনায় বেড়ে উঠতে থাকেন উমর। তাই মদিনার বড় বড় সাহাবির সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা হতো। আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.)-এর যেকোনো দরসে তিনি শৈশবকাল থেকেই যাতায়াত করতেন। কারণ তাঁর মা আবদুল্লাহ বিন উমরকে সব বিষয়ে খুবই গুরুত্বারোপ করতেন। ছোটবেলায় প্রায় তিনি আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.)-এর দরস থেকে এসে মাকে বলতেন, ‘আম্মু, আমি নানার মতো হব।’ তখন মা উত্তরে বলতেন, ‘সফর করো, ইলম অর্জন করো। ওনার মতো হতে পারবে।’ প্রায়ই তিনি মাকে এ কথা বলতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১৪৪/৫)।

কিছুদিন পর তাঁর বাবা আবদুল আজিজ গভর্নর হিসেবে মিসর যান। সেখানে গিয়ে আবদুল আজিজ উম্মে আসেমকে চিঠির মাধ্যমে জানান, সে যেন ছেলেকে নিয়ে তাঁর কাছে চলে আসে। উম্মে আসেম চিঠি নিয়ে আবদুল্লাহ বিন উমরকে দেখালে তিনি বলেন, ‘হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্রী, তিনি তো তোমার স্বামী। অতএব তাঁর কাছে চলে যাও।’ তবে যাওয়ার প্রাক্কালে আবদুল্লাহ (রা.) কিশোর উমরের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘তবে এ ছেলেকে আমাদের কাছে রেখে যাও। তোমাদের মধ্যে একমাত্র সেই আমাদের সঙ্গে বেশি মাননসই।’ উম্মে আসেম চাচার কথা পালন করে ছেলেকে মদিনায় রেখে মিসর চলে যান। কিন্তু আবদুল আজিজ সন্তানকে মায়ের সঙ্গে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন। উম্মে আসেম স্বামীকে সব কিছু বললেন। তাঁর কথা শুনে আবদুল আজিজ অত্যন্ত খুশি হন। ইসলামের দূরদর্শী খলিফা উমর (রা.)-এর পরিবারের সদস্যদের মাঝে মদিনাতে উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)-এর শৈশব ও কৈশোরকাল কাটতে লাগল।

প্রিয়নবী (সা.)-এর সাহাবিদের একান্ত সান্নিধ্যে কাটতে শুরু করল উমরের সময়। শিশুকাল থেকেই ইলম অর্জনের প্রতি ছিলেন প্রবল আগ্রহী। আলেমদের কথা শোনা ও তাঁদের সান্নিধ্যে থেকে অধ্যয়ন করার প্রতি খুবই গুরুত্ব ছিল তাঁর। ওই সময় মদিনা ছিল সাহাবি, তাবেয়ি, প্রখ্যাত ফকিহ ও আলেমদের পদচারণে মুখরিত। তাই মদিনার ইলমের মজলিসগুলোতে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। অথচ তখনো তিনি কৈশোরের দস্যিপনার সময়ও অতিক্রম করেননি। বুদ্ধিমান হওয়ার পর থেকেই ইলমের প্রতি প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনা ছিল চোখে পড়ার মতো। আল্লাহ তাআলা তাঁর নিবিড় পরিচর্যায় বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা কুদরতিভাবে করে দিয়েছেন।

শৈশবের এ সময় উমর বিন আবদুল আজিজ পবিত্র কোরআন হেফজ সম্পন্ন করেন। স্বচ্ছ পবিত্র অন্তরের অধিকারী হওয়ায় তাঁর জন্য এটি সহজই ছিল। তা ছাড়া সব কিছু থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিপূর্ণভাবে ইলম অর্জনের জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। কোরআন তেলাওয়াতের সময় খুবই কান্না করতেন তিনি। বয়স বাড়তে থাকলে তা আরো বৃদ্ধি পায়। এ কথা তাঁর মা জানতে পেরে তাঁকে চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কান্না করো কেন? তখন উত্তরে ছোট্ট উমর বললেন, আমার মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। ছেলের কথা মায়ের কাছে পৌঁছলে মাও কান্না শুরু করেন।

উমর (রহ.) বেড়ে ওঠার সময় সমাজের সর্বত্র ছিল তাকওয়া ও ইলমচর্চায় ভরপুর। তা ছাড়া মদিনায় তখনো অনেক সাহাবি অবস্থান করছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে তিনি ইলম অর্জন করতে থাকেন। এমনকি তিনি রাসুল (সা.)-এর খাদেম আনাস (রা.)-এর নামাজে ইমামতি করেন। তখন আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর নামাজের সঙ্গে এ যুবকের মতো এত সাদৃশ্যপূর্ণ কারো নামাজ আমার চোখে পড়েনি।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১১৪/৫)।

মদিনার শ্রেষ্ঠ ফকিহ ও আলেমদের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন উমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)। উমরের পিতা আবদুল আজিজ ছেলের সুশিক্ষার জন্য বিজ্ঞ আলেম সালেহ বিন কাইসান (রহ.)-কে নির্বাচন করেন। সালেহ বিন কাইসান আচার-ব্যবহার, চলাফেরাসহ সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা উমরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কাজ ছিল। একদিন জামাতে আসতে তাঁর দেরি হয়। তখন হজরত সালেহ হজরত উমরকে কারণ জিজ্ঞেস করলে উমর বললেন, চিরুনি দিয়ে চুল পরিপাটি করছিলাম। তখন তিনি বলেন, চুল চিরুনি করা তোমার কাছে এতই পছন্দ হলো যে তুমি জামাতে নামাজ আদায়ের পরিবর্তে সেটাকে প্রাধান্য দিলে?’ অতঃপর তিনি তাঁর বাবা আবদুল আজিজের কাছে এ বিষয়ে চিঠি লিখলেন। আবদুল আজিজ একজন দূত প্রেরণ করলেন। দূত উমরের সঙ্গে কোনো কথা না বলেই তাঁর মাথা মুণ্ডিয়ে দিল।’ (সিরাতে উমর বিন আবদুল আজিজ : ৩১৬)।

তাঁর বাবা আবদুল আজিজ হজ পালন করতে এসে মদিনায় জিয়ারতে আসেন। তখন ছেলের শিক্ষক সালেহ বিন কাইসানকে ছেলের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। সালেহ বিন কাইসান বললেন, ‘আমি তো এমন কাউকে দেখিনি, যার অন্তরে এ ছেলের মতো আল্লাহর ভয় আছে।’

উমর (রহ.)-এর প্রিয় শায়খদের অন্যতম হলেন তাঁর প্রিয় মামা সালেম বিন আবদুল্লাহ বিন উমর (রহ.), ওবায়দুল্লাহ বিন আবদুল্লাহ বিন ওতবা বিন মাসউদ (রহ.) ও  সায়িদ বিন মসায়্যিব (রহ.)। প্রখ্যাত তাবেয়ি সায়িদ বিন মুসায়্যিব (রহ.) উমর বিন আবদুল আজিজ ছাড়া আর কোনো শাসকের কাছে যাননি।

৮৭ হিজরিতে চাচা খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান তাঁকে মদিনার গভর্নর নিযুক্ত করেন। ৯১ হিজরিতে তিনি তায়েফসহ পুরো হেজাজের গভর্নর হন। কিছুদিন পর এ পদ থেকে বরখাস্ত হয়ে দামেশকে চলে যান। খলিফা সুলাইমান বিন আবদুল মালিকের সময় মন্ত্রী ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। অতঃপর ৯৯ হিজরিতে তিনি আমিরুল মুমিনিন তথা মুসলিম উম্মাহর খলিফা নিযুক্ত হন।

উমরের বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর চাচা খলিফা আবদুল মালিক নিজ কন্যা ফাতেমার সঙ্গে উমরের বিয়ে দেন। ফাতেমার মতো বিদুষী নারী ইতিহাসে কমই আছে। ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে, তাঁর দাদা, বাবা, স্বামী ও চার ভাই—সবাই ছিলেন খলিফা। এক পরিবার থেকে সাতজন খলিফা হওয়ার এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার পরও ফাতেমা উমরের দুঃখ-কষ্টভরা অনাড়ম্বর জীবনকে গ্রহণ করে কাটিয়ে দেন সারা জীবন।

শৈশব থেকে মদিনা নগরীতে চিন্তাশীল মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠায় দৃঢ়তা ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ছিল উমরের প্রধান গুণাবলি। তাই খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে খেলাফতব্যবস্থার সংস্কারে অনেক কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মজলিসে শুরা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, অত্যাচার-নিপীড়নমূলক সব নীতিমালা পরিহার, জনসাধারণের মাঝে ইলমের প্রচার-প্রসার ও ইলমে হাদিস সংকলনের সূচনাসহ অনেক জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি। আর খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও সার্বিক জীবনযাপনে তাঁর মতো সাদাসিধা অনাড়ম্বর খোদাভীরু শাসক সত্যিই ইতিহাসের পাতায় বিরল।

কিন্তু তাঁর এ ন্যায়ের বারিধারা অব্যাহত থাকেনি বেশি দিন। কারণ এত কঠিন ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে জীবনযাপন করা উমাইয়া বংশের অন্য শাসকদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর শাসনকাল ছিল মাত্র দুই বছর পাঁচ মাস। উমাইয়া শাসকদের ষড়যন্ত্রে অবশেষে ১০১ হিজরিতে বিষ প্রয়োগের কারণে মুসলিম উম্মাহর মহান খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজ মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৯ বছর পাঁচ মাস চার দিন। (সিরাতে উমর বিন আবদুল আজিজ : ৩১৬)সুত্র ঃ দৈনিক কালের কন্ঠর ইসলাম ও জীবন পাতা।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.