তাঁদের সব ছিল। বাড়ি, গাড়ি, দু’টি সফল ব্যবসা, সুখী ও স্বচ্ছল দাম্পত্য জীবন। ছিল তিনটি ফুটফুটে সন্তান। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া শহরে স্বপ্নের জীবনই যাপন করছিলেন তাঁরা। কিন্তু তবু, কী যেন মিসিং ছিল সেই জীবনে। কী যেন এক শূন্যতা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, ৩৪ বছরের সারা এবং জার্মাইন গ্রিগসকে।

এই তাড়নাকে সাড়া দিতেই বেরিয়ে পড়া ঘর ছেড়ে, সাজানো যাপন ছেড়ে। পৃথিবী ঘুরে দেখতে হবে, বিশ্ব জোড়া পাঠশালায় পৌঁছে দিতে হবে সন্তানদের। নানা রকমের সংস্কৃতি, অ্যাডভেঞ্চার, জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত করতে হবে তাদের। গ্রিগস দম্পতির সুখী জীবনের খচখচে কাঁটা বলতে ছিল এটুকুই। যাঁদের মূল মন্ত্র ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগতটাকে’– তাঁরা যে শান্ত, নিস্তরঙ্গ, সুখের জীবনে শান্তিতে থাকতে পারবেন না, তা বলাই বাহুল্য।

তাই সুখের ঘরে তালা দিয়ে, বিশ্বের দরবারে আরও বড় আনন্দের চাবিকাঠি খুঁজতে তিন সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন গ্রিগস দম্পতি। ঠিক করেছেন, গোটা জীবনটাই ঘুরবেন পৃথিবীর নানা দেশে। পুঁথিগত পড়াশোনাটুকু নিজেরাই করাবেন বাচ্চাদের। বাকি শিক্ষা দেবে প্রকৃতি, পর্যটন, পৃথিবী।

মিশরে

এই বেরিয়ে পড়ার পরে কেটে গিয়েছে বছর দুই। মিশর, ভারত, থাইল্যান্ড, ইউনাইটেড আরব এমিরেটস, হাওয়াই, নিউজ়ি ল্যান্ড, পর্তুগাল-সহ ১৬টি দেশ এর মধ্যেই ঘুরে ফেলেছেন তাঁরা। আহরণ করেছেন জীবনের সেরা মুহূর্তদের। সঞ্চয় করেছেন সুন্দরতম স্মৃতি। এ সবের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছে তিন তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে।

“এটা একটা বোধ। একটা ধাক্কা। আমাদের মনে হয়েছিল, এটাই আমাদের জীবনের সব চেয়ে সেরা সময়, যা আমরা পাঁচ জন একসঙ্গে কাটানোর সুযোগ পাচ্ছি। তাই এই সময়টা যদি আমরা সমাজের ঠিক করে দেওয়া খাঁচায় বন্দি থেকে বাঁচি, তা হলে আমরা নিজেদের মতো বাঁচব কবে!”– বলছিলেন জার্মাইন। আরও বলেন, “সারা পৃথিবী ঘুরে দেখার ইচ্ছে আমাদের দু’জনেরই ছিল। কিন্তু তিন-তিনটে ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে এভাবে ঘোরা অসম্ভব মনে হতো। আমরা সব সময় ভাবতাম, সময় এলেই বেরোব। কিন্তু ঠিক সময় কখন আসে? কখনওই না। সময় আসে না, নিজেকে সময়ের কাছে নিয়ে যেতে হয়। তাই আমরা ঠিক করলাম, বেরিয়ে পড়ব। আমাদের বাড়ি বিক্রি করে দিলাম। বাচ্চাদের স্কুলে জানিয়ে দিলাম,ওরা আর আসবে না। এবং গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম সব কিছু।”

থাইল্যান্ডে

সারা বলছিলেন, “আমাদের বাচ্চারা বাড়িতেই পড়াশোনা করে। বা বলা ভাল, পৃথিবী জুড়ে পড়াশোনা করে। এটাই ওদের ‘ওয়ার্ল্ড স্কুল’। আমি আর জার্মাইন দু’জনেই বিশ্বাস করি, শেখার জন্য পৃথিবীর চেয়ে ভাল স্কুল আর হয় না। এর মানে অবশ্য এই নয়, যে ওরা আর কখনও প্রথাগত স্কুলে ফিরতে পারবে না। কিন্তু এখন ওরা বিশ্বমানের পড়াশোনাই করছে, কিন্তু সেটা নির্দিষ্ট কোনও স্কুলে নয়। খানিক আমাদের কাছে, খানিক অনলাইনে। ওরা অনেক কিছু শিখছে। অভিজ্ঞতার কথা ছেড়ে দিলাম।”

ইউনাইটেড এমিরেটস অফ আরবে

জার্মাইন এবং সারা দু’জনেই খুশি, এ ভাবে পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে। ওঁরা বলছিলেন, প্রতিটি দেশ কী ভাবে আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা উপহার দিচ্ছে। কোথাও দু’সপ্তাহ, কোথাও বা দু’দিন। দিব্যি সংসার পাতছেন তাঁরা। হলই বা অস্থায়ী, হলই বা সংক্ষিপ্ত। গভীরতা বা বিস্তারের দিক থেকে এ সংসার ছুঁয়ে ফেলে বিশ্ব-সংসারের ধারণাকে।

জার্মাইন বললেন, “এই ভাবেই প্রতিটা দেশে, প্রতিটা নতুন খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সংস্কৃতি,আবহাওয়ার সঙ্গে আমরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। আমরা ঘরের মতোই আরাম খুঁজে পাচ্ছি ঘরের বাইরেও। যেমন একটা উদাহরণ দিই: অনেকেই আমাদের বলেছিল, ভারতে গিয়ে হয়তো আমাদের বাচ্চাদের অসুবিধা হবে। ওখানে খুব গরম, খাবারদাবারও অনেক বেশি মশলাদার। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম তাজমহল দেখতে। তাই শুধু তাজমহলকে কেন্দ্র করে ছোট একটা ট্রিপ করেছি ভারতে। কিন্তু নিজেরা ওইটুকু ঘুরে দেখার পরে বুঝতে পারলাম, আমাদের আরও এক বার ভারতে আসতে হবে অনেক বেশি দিনের জন্য।”

ভারতে

তাজ মহলকে সেরা স্মৃতিদের তালিকাতেই রেখেছেন জার্মাইন-সারা। সেই সঙ্গে আছে নিউ জ়িল্যান্ডের কুইন্সটাউনের হিমবাহতে হেলিকপ্টারে করে নামা, ফিজিতে সমুদ্রের বুক দিয়ে ওড়া– এ সব অসংখ্য মারকাটারি অভিজ্ঞতা। তাঁদের বড় মেয়ে, ১১ বছরের জাদিন আবার সব চেয়ে খুশি হয়েছে বালির উবুদ শহরে বাঁদরের অভয়ারণ্য দেখে। ছোটবেলা থেকেই এই প্রাণীটি তার খুব প্রিয়। তাই জঙ্গল ভর্তি বাঁদর দেখে খুবই পুলকিত জাদিন।

এমনকী তার প্রিয় সিনেমা হল, ‘প্ল্যানেট অফ দ্য এপস’। চার দিকে হাজার হাজার বাঁদর মুক্ত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, লাফাচ্ছে, দোল খাচ্ছে– এ সব দেখে সে বড়ই আনন্দ পায়। তার খুবই ইচ্ছে, এই প্ল্যানেটে যদি যাওয়া যেত। উবুদে গিয়ে তার মনে হয়েছে, সেই সিনেমাই যেন চোখের সামনে ঘটছে। এ যেন স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো।

নিউ জ়িল্যান্ডে

সারা-জার্মাইনের ব্যবসা দেখছেন তাঁদের পরিবার। দু’টি ব্যবসাই প্রতিষ্ঠিত, তাই খুব একটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু তবু তাঁদের এ ভাবে সাপোর্ট করার জন্য পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ তাঁরা। যদিও অনলাইনে অনেকটা কাজই সামলে নিতে পারেন জার্মাইন ও সারা। তবে এবার তাঁরা ভাবছেন, নিজেদের একটা ব্লগ খুলবেন। ট্র্যাভেলের অভিজ্ঞতা ও নানা রকম টিপস শেয়ার করবেন সেখানে। যে সব পরিবার তাঁদের মতোই বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে চান, তাঁদের কাজে লাগতে পারে এই ব্লগ।

তাঁরা ভ্রমণপ্রেমী অভিভাবকদের বার্তা দিতে চান, ঘরের বাইরে বেরিয়ে যে শিক্ষা হয়, বাচ্চারা তা কখনওই নিজের ঘরে নিজের স্কুলে পেতে পারবে না। ট্র্যাভেল করলে তাদের চেতনা ও বোধের বিকাশ অনেক বেশি গভীর হয়। তাদের দুনিয়াটা অনেক বড় হয়, দৃষ্টিভঙ্গি উদার হয়। হৃদয়বত্তা অর্জন করার সুযোগ পায় তারা। পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা একমাত্র বাইরের জগতই দিতে পারে। ঘরের দেওয়াল নয়। সারা দুনিয়া জুড়ে নতুন বন্ধু করছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। ভাঙছে ভাষার দেওয়াল। হাসি, কান্না, মজার কোনও আলাদা ভাষা হয় না।

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে

“আমরা বিশ্বাস করি, যখন আমাদের বাচ্চারা পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তের বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, হাসছে, খেলছে, তখন পৃথিবীর অন্য কোনও খারাপ, কোনওযুদ্ধ, রাজনীতি, কূটনীতি ওদের সরলতাকে নষ্ট করতে পারবে না।”– বললেন তিন সন্তানকে নিয়ে পৃথিবী ঘুরতে বেরোনো সম্পতি সারা এবং জার্মাইন।