সভ্যতা ও সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর মেসোপটেমিয়া, আজও বিস্ময় জাগায়
উত্তরে আর্মেনিয়ার পার্বত্য অঞ্চল, দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরব মরুভূমি ও পূর্বে জাগরাস পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে ঘেরা এই নদী দু’টির যাত্রাপথ। এই নদী দু’টির মধ্যে থাকা উর্বর ও অর্ধচন্দ্রাকৃতি অববাহিকার নাম ছিল মেসোপটেমিয়া। খ্রীষ্টপুর্ব ৬০০০ অব্দ নাগাদ বিভিন্ন জায়গার মানুষেরা আসতে থাকে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মেসোপটেমিয়ায়।
একসময় বহিরাগত ও আদিম আরব যাযাবর সংস্কৃতির মিলনে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত এক সভ্যতা। মেসোপটেমিয় সভ্যতা। যে সভ্যতাকে বলা হয় আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট-এও যার উল্লেখ আছে। মূলত চারটি সভ্যতার ধারা নিয়ে এই আধুনিক সভ্যতাটি গড়ে উঠেছিল। সেগুলি হল সবচেয়ে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতা, আক্কাদীয় সভ্যতা, অ্যাসসিরীয় সভ্যতা ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা।
মেসোপটেমিয় সভ্যতা তার সর্বোচ্চ উচ্চতায় প্রবেশ করেছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০-৩৫০০ অব্দে। কিন্তু প্রাকৃতিক দিক থেকে এলাকাটি সুরক্ষিত না হওয়ায়, ৩৩৩ খ্রীষ্টাব্দে এসে মেসোপটেমিয় সভ্যতাটি বহিঃশত্রুদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন জনগোষ্ঠির অন্তঃকলহের জেরে ধীরে ধীরে সভ্যতাটির অবলুপ্তি ঘটে ।
ধাতু ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেসোপটেমিয়রা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়েছিল। মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন মন্দির এবং জিগুরাট থেকে পাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী থেকে অনুমান করা হয় তারাই সম্ভবত তামা ও টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জের ধাতু আবিষ্কার করেছিল। খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু করেছিল। এমনকি, খ্রীষ্টপুর্ব ১৬০০ অব্দ থেকে মেসোপটেমিয়ায় কাচের ব্যবহারও শুরু হয়েছিল।
মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা বিশ্বাস করত আকাশে স্বর্গ এবং মাটির নীচে নরক আছে। তারা বিশ্বাস করত, পৃথিবী হল একটি গোলাকার চাকতি, যা একটি বিশাল গহ্বরের মধ্যে অবস্থিত। পৃথিবী জল দিয়েই তৈরি এবং পৃথিবীর চারপাশ জুড়েই জল আছে।মেসোপটেমিয়রা বহু ইশ্বরে বিশ্বাস করত এবং বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি পূজা করত।
তবে ধর্মসহিষ্ণুতার দিক থেকে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মানুষেরা অনেক এগিয়ে ছিল। প্রতিটি জিগুরাট ও মন্দিরেই বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ যেমন ধনী, দরিদ্র, ব্যবসায়ী, কামার, মজুর, কৃষক ইত্যাদি শ্রেণীর লোকেদের বসার ব্যবস্থা ছিল। এই সভ্যতার মানুষেরা যে যার নিজস্ব জায়গায় গিয়ে দেবতাদের আরাধনা করত ও দেবতাদের উদ্দেশে বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করত।
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন এই সভ্যতাটিকে আজও পৃথিবীতে পথীকৃত হয়ে আছে। তার সমৃদ্ধি, তার নগর জীবন ও অত্যন্ত উন্নতমানের গণিতবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সাহিত্যের উন্নতি ও উৎকর্ষতার জন্য।
গণিতবিদ্যা
কৃষিজীবী হলেও সময়ের তুলনায় মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা চিন্তার দিক থেকে অনেক এগিয়েছিল। অধিবাসীরা কৃষিতে উদ্বৃত্ত ফসল মন্দিরে জমা দিত। মন্দিরের পুরোহিতরা পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে কে কতটা ফসল জমা দিল তার হিসাব রাখত। হিসাব রাখার অসীম গুরুত্ব বুঝতে পেরে একদিন মেসোপটেমিয়রা তাদের নিজস্ব গণিত শাস্ত্র সৃষ্টি করে নিয়েছিল।
এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া কাদামাটির ফলক থেকে, তাদের গণিত সম্পর্কে আমরা জানতে পারি । কাঠের তৈরি ত্রিভুজাকার মাথার কলম নরম মাটির ফলকে গেঁথে অঙ্ক কষা হতো, এই লিখনপদ্ধতিকে বলা হয় কিউনিফর্ম।
সবচেয়ে প্রাচীন ফলকগুলি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ের বলে মনে করা হয়। ফলকগুলির ওপরে কষা সমস্ত অঙ্কই ছিল ব্যবসাকেন্দ্রিক।
এ বার জেনে নেব মেসোপটেমিয়ার গণিত সংক্রান্ত কিছু তথ্য।
● রাষ্ট্র, মন্দির ও জনগণের মধ্যে সম্পদ কী ভাবে বন্টিত হবে তা হিসাব করা হত গণিতের সাহায্যে।
● শস্যর বীজ বপন ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য পাঁজি তৈরির ক্ষেত্রেও গণিতের ব্যবহার ছিল।
●মেসোপটেমিয়দের সংখ্যাগুলি ছিল ‘ষাট’ কেন্দ্রিক। সেখান থেকেই সম্ভবত এক ঘন্টায় ষাট মিনিট ও এক মিনিটে ষাট সেকেন্ডের হিসাব শুরু হয়েছিল। কারণ, তারাই প্রথম এক বছরকে ১২ মাসে এবং এক মাসকে ৩০ দিনে ভাগ করেছিল। তবে তাদের গণিতে শুন্যের ধারণা ছিল না
● বৃত্তকে ৩৬০টি ভাগে বা ডিগ্রিতে বিভক্ত করেছিল তারাই।
● তারাই প্রথম ১২টি রাশিচক্র এবং জলঘড়ি আবিষ্কার করে।
●তাদের গণিতে পাটীগণিতের প্রাধান্য ছিল। অর্থ ও পণ্যদ্রব্য আদানপ্রদানের জন্য পাটীগণিত ও সরল বীজগণিত ব্যবহার করত। সরল ও যৌগিক সুদ গণনা করতে পারত।
● জ্যামিতিতে পরিমাপ ও গণনাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। খাল কাটা, শস্যাগার নির্মাণ ও অন্যান্য সরকারি কাজকর্মের জন্য পাটীগণিত ও জ্যামিতির ব্যবহার হত।
●বিপরীত সংখ্যা , বর্গ সংখ্যা , বর্গমূল, ঘন সংখ্যা ও ঘনমূলের ব্যবহার ছিল তাদের অঙ্কে।
●দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের সূত্র আবিষ্কার করেছিল এবং তারা দশটি অজানা রাশি বিশিষ্ট দশটি সমীকরণের অঙ্ক সমাধান করতে পারত।
জ্যোতির্বিজ্ঞান
মেসোপটেমিয় সভ্যতা শুভ-অশুভ ক্ষণ নির্ণয়ের জন্য গ্রহ নক্ষত্র দেখার রীতি ছিল। তখনও টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি, খালি চোখেই নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করত তারা।
●গণিত ব্যবহার করে চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহের গতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিল তারা। এর ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল।
●গ্রহ-নক্ষত্রগুলির গতিবিধির ছক আঁকতে জানত তারা। সেই অনুযায়ী তাদের ক্যালেন্ডার তৈরি করত।
● দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হত মানমন্দিরগুলিতে। ঋতু নির্ণয়ের মাধ্যমে শস্যরোপনের সময় বার করা ও বছরের দৈর্ঘ্য মাপা।
● এই সভ্যতার মানুষরাই প্রথম আবিষ্কার করেছিল, সারোস নামে একটি চক্রাকার পথে চন্দ্রগ্রহণ ঘটে থাকে।
● প্রথম দিকে পৃথিবীটকে চ্যাপ্টা চাকতির মতো ভাবলেও, পরে তাদের ধারণা হয় পৃথিবীটা গোলাকার। এরপর তারাই প্রথম পৃথিবীকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করার পরিকল্পনা করে।
ভাষা
সভ্যতার প্রথম স্তরে মেসোপটেমিয়রা সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর সুমেরীয় ভাষায় কথা বলত। এই ভাষা দিয়ে তারা দৈনন্দিন ভাবের আদান প্রদান ছাড়াও প্রশাসনিক কাজকর্ম, ধর্ম ও বিজ্ঞানচর্চা করত।
ভাব বা বার্তা বোঝানোর জন্য আধুনিক লেখন পদ্ধতির উদ্ভাবক তারাই। তাই মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় ভাষাকে পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো লিখিত ভাষা হিসেবে ধরা হয়। প্রথম পাওয়া লিপিটির বয়স ৫,১০০ থেকে ৪,৯০০ বছরের মতো।
প্রাথমিক অবস্থায় সুমেরীয় লিখন পদ্ধতি ছিল শব্দনির্ভর, অর্থাৎ সাধারণত একটি চিহ্ন দিয়ে একটি সম্পূর্ণ শব্দ প্রকাশ করা হতো। কয়েক শতাব্দী পর এই ব্যবস্থা সহজ করার জন্য ‘লোগো-সিলেবিক’ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।
একটি চিহ্ন দিয়ে একটি আস্ত শব্দ না বুঝিয়ে একটি শব্দাংশ বা সিলেবল প্রকাশ করা হতো। এখনও চিন ও জাপানে ভাষা লেখার জন্য মোটামুটি একইরকম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে মেসোপটেমিয়ার ‘লোগো-সিলেবিক’ পদ্ধতি আরও পরিশীল হয়ে বর্ণমালার রূপ নেয়।
এই বর্ণমালা দিয়ে লেখা বিভিন্ন দলিল পরবর্তীকালে পাওয়া গেছে। সেই সময়ের লেখালেখি শুধুমাত্র হিসাব রাখার কাজে ব্যবহার হত। আজকের যুগে অফিসে কাজকর্মের নথিপত্র রাখার যে ব্যবস্থা তার কৃতিত্ব কিন্তু মেসোপটেমিয়ার।
সাহিত্য
সাহিত্যের জন্য মেসোপটেমিয়রা যে ভাষা ব্যবহার করত তাকে বিজ্ঞানীরা হেমেটিক ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন। হোমার তাঁর ইলিয়াড এবং ওডিসি লেখারও প্রায় এক হাজার বছর আগে সুমেরীয়রা তাদের নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিল।দপ্তরিক এবং রাজকীয় দলিলপত্র ছাড়াও মেসোপটেমিয় সভ্যতায় প্রচুর ধর্মীয় এবং সমাজভিত্তিক সাহিত্য লেখা হয়েছিল।
বিশ্ববিখ্যাত মহাকাব্যিক কাহিনী গিলগামেশ এই ভাষাতেই রচিত। যা লেখা হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত মেসোপটেমিয় নগর উরুকের প্রথম দিকের এক শাসককে নিয়ে। তবে মেসোপটেমিয়ার নগরজীবন, বাণিজ্য ও সাহিত্যর অভ্যন্তরীণ সম্পর্কও উঠে এসেছিল এই কাহিনীটিতে।
তবে ‘গিলগামেশ’ পড়লে বোঝা যাবে এখানকার লোকজন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ ছিল। যেটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অন্যতম মূলধন বলে প্রমাণিত। আবার এই সভ্যতার কিছু লেখায় পারলৌকিক চিন্তাভাবনা দেখা গেছে। তবে সেগুলি ছিল ধর্মীয় সাহিত্য।
পৃথিবীকে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিল এই সভ্যতাই
আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর মেসোপটেমিয়াই সেই জায়গা যেখানে পৃথিবীর প্রথম আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল। প্রথমে নগর কেন্দ্রিক প্রশাসনিক বৃত্ত, এরপর ছিল রাজ্য কেন্দ্রিক প্রশাসনিক বৃত্ত এবং সব শেষে ছিল সুবিশাল সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক প্রশাসনিক বৃত্ত।
তাই মনে করা হচ্ছে মেসোপটেমিয় সভ্যতা ছিল গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘরও। যেখানে মানুষ তাদের মতামত নির্ভয়ে প্রকাশ করত। যেখানে ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা। সর্বোপরি রাষ্ট্র, মন্দির ও জনগণের মধ্যে জাতীয় সম্পদ নিখুঁতভাবে হিসাব করে বন্টন করা হত, যাতে জনসাধারণ অভাবে না পড়ে।