ফিরে দেখা ১৫ আগস্ট সন্তান ও পরিবার সদস্যদের লোমহর্ষক হত্যার বর্ণনায় ঘাতকের বুলেটে সন্তানহারা আহত জননী শাহানারা আবদুল্লাহ

0
(0)

ফিরে দেখা ১৫ আগস্ট
সন্তান ও পরিবার সদস্যদের লোমহর্ষক হত্যার বর্ণনায়
ঘাতকের বুলেটে সন্তানহারা আহত জননী শাহানারা আবদুল্লাহ
আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল G
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ফজরের আযানের ধ্বনি কানে ভেঁসে আসছিল চারিদিক থেকে। ঠিক এই সময় বুটের আওয়াজের সাথে অতর্কিত বুলেটের শব্দে কেঁপে উঠলো ঢাকার ২৭নং মিল্টো রোডের বাড়িটি।
ঘাতকদের আগমনে শব্দে চার বছরের শিশু সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু সেরনিয়াবাত ভীত হয়ে আশ্রয় চাইলেন মমতাময়ী মা শাহানারা আব্দুল্লাহর কোলে। কিন্তু শিশু পুত্রর শেষ আবদার টুকু রাখতে পারলেন না মমতাময়ী মা। তার আদরের ছোট্ট শিশুপুত্রকে আর কোলে নিতে পারনৈ না তিনি। তার আগেই নির্লিপ্ত ঘাতকেরা মায়ের চোখের সামনেই নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করে শিশু সুকান্ত আবদুল্লাহ ওরফে বাবু সেরনিয়াবাতকে। ঢাকার ২৭নং মিল্টো রোডের বাড়িটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের সদর দপ্তর।
অশ্রু সজ্জল নয়নে সেই দিনের হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সাবেক মন্ত্রী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র বধু, জাতির পিতার ভাগ্নে, মন্ত্রী পদ মর্যাদায় পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সন্তান হারা আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সহধর্মিনী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বেগম শাহানারা আব্দুল্লাহ বলেন,
ঘাতকেরা বাড়িতে ঢোকার পর “বাবু আমার কোলে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন আমি বাবুকে কোলে নিতে পারিনি। চোখের সামনেই সন্তানের নির্মম মৃত্যু দেখলেও কিছুই করতে পারিনি সেদিন”। কথাগুলো বলতে বলতে অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে পরেন তিনি।
সূত্রমতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলার পাশাপাশি তার বোন জামাতা ও দক্ষিণ বাংলার কৃষককুলের নয়নমনি খ্যাত তৎকালীন বন্যা নিয়ন্ত্রন, সেচ ও পানি সম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২৭নং মিন্টো রোডের বাড়িতেও হত্যাযজ্ঞ চালায় ঘাতকেরা। সেখানে মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ ছয় জনকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের নাতি ও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ দম্পত্তির চার বছরের শিশু পুত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু সেরনিয়াবাতও ছিলেন।
সন্তান হারা মমতাময়ী মা শাহানারা আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘সেদিন (১৫ আগস্ট) ফজরের আযানের পর আমরা প্রচন্ড গুলির শব্দ শুনছিরলাম। শব্দটা ধেয়ে আমাদের বাসার দিকেই আসছিল। গুলির শব্দে হঠাৎ করে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমার শ্বাশুরী (বঙ্গবন্ধুর বোন আমেনা বেগম) বলেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, ডাকাত পড়েছে, আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দাও’। আমার শ্বশুর আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুকে একটা ফোনও করেছিলেন। কিন্তু কি কথা হয়েছে, বলতে পারবো না। এরইমধ্যে আমি শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে ফোন করলাম। ফোনে তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির দিকে কারা যেন গুলি করতে করতে আসছে, বুঝতে পারছিনা। মনি ভাই বলেন, কারা গুলি করছে দেখো। বললাম, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না। মনি ভাই বলেন, তারপরেও দেখো, কারা আসছে। এরমধ্যে ফোনটি আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে আমার শাশুড়ি মনি ভাইকে বলেন, বাবা বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, আমাদের বাঁচাও। এই কথা বলেই ফোন রেখে দিয়ে আমার শাশুড়ি আমার শ্বশুরকে বললেন, কি ব্যাপার তুমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) ফোন দিলা না ? আমার শ্বশুর বলেন, তোমার ভাইও মনে হয় রেহাই পায়নি। ওনার সাথে কি কথা হয়েছে আমরা সেটা শুনিনি। আমাদের দরজা ভাঙ্গার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা চিৎকার শুনলাম, তোমরা সামনে এগুবে না, ভালো হবেনা। এসময় ওরা (ঘাতকেরা) থমকে দাঁড়ায়। ওই চিৎকারটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ)। এরপর উনি দোতলায় চলে যান। কাজের বুয়া দরজাটা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করে দেয়ার পর উনি আমাদের ঘরে না ঢুকে ডান পাশের রুমে ঢুকে যান। পরে আমরা জানতে পারি, একটা ফোন আসে (ফোনটি রিসিভ করে হাসানাত) মনি ভাই মারা গেছেন।’
চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে শাহানারা আবদুল্লাহ আরও বলেন, এরমধ্যে ঘাতকেরা বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করেছে। তারা রুমে রুমে ঢুকে হ্যান্ডস আপ হ্যান্ডস আপ বলে আমাদের সবাইকে কর্ডন করে নিচতলার ড্রইং রুমে জরো করে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখে। সিঁড়ির অর্ধেক নেমেই বাবু (সুকান্ত বাবু) বলে, মা আমি তোমার কোলে উঠবো। আমি ওকে কোলে নিতে পারলাম না। পাশে আমার ভাসুর (সহিদ সেরনিয়াবাত) ওকে কোলে নিল। নিচে নামার পর ভাড়ি অস্ত্র ঠেঁকিয়ে ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে উপরে আর কে কে আছে? এমন সময় আমার শ্বশুর আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন তার চোখের ইশারায় আমি বললাম, ওপরে আর কেউ নেই। যে কারণে উপরের রুম গুলো তল্লাশী না হওয়ায় আমার স্বামী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে ওরা খুঁজে পায়নি। শাহানারা আবদুল্লাহ বলেন, ‘তখনও আমরা বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে, না গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। আমার শ্বশুর ওদেরকে বললো, তোমরা কি চাও। তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে। ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে, আমরা কিছুই চাই না, আমাদের কোনো কমান্ডিং অফিসার নেই। এই কথা বলার সাথে সাথেই ঘাতকেরা ব্রাশ ফায়ার করে। আমরা মাটিতে পরে যাই।’
এ কথা বলতে বরতৈ শাহানারা আবদুল্লাহর চোখ বেয়ে ঝড়ে পরে অশ্রু। কন্ঠ ভারি হয়ে ওঠে তার। কিছু সময়ের জন্য চুপ থেকে চোখের জল মুছে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘সহিদ ভাইকে অস্ত্র ঠেঁকিয়ে ওরা গুলি করে। উনি সাথে সাথে উপুর হয়ে পরে যান। আমার শ্বশুরের শরীর দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমার শরীরের পিছনের অংশে হাত দিয়ে দেখি রক্ত বের হচ্ছে। ওরা চলে যেতে লাগল। তখনও আমার জ্ঞান ছিলো। এরই মধ্যে কে যেন কান্না করে ওঠে। এরপর ঘাতকরা আবার দৌঁড়ে এসে ব্রাশ ফায়ার করে। এবার ওরা নিচ দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। আমার শ্বশুর সাথে সাথেই মারা যান। আমি আমার শ্বশুরের পিছনে ছিলাম, আমার কোমরে গুলি লাগে। ব্রাশ ফায়ারে ছয়জন মারা যায়। আমরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যু সন্ধিক্ষনে নয় জনে কাতরাচ্ছিলাম। এরমধ্যে আবার একদল লোক গাড়ি নিয়ে আসে। তখন ভাবলাম এই বুঝি শেষ। কিন্তু পরে দেখি রমনা থানার পুলিশ এসেছে। তারা আমার শ্বশুরের পালস্ দেখে বলে, বাড়ির কেউ আহত আর কেউ মারা গেছে। দীর্ষ নিঃশ্বাস ফেলে মমতাময়ী শাহানারা আবদুল্লাহ বলেন, ‘পুলিশ আসার পর বাবুকে সহিদ ভাইয়ের বুকের নিচ থেকে উঠানো হল। দেখালাম ওর নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে। কিছু সময় আগে যে সন্তান আমার কোলে উঠতে চেয়েছিল, তাকে কোলে নিতে পারি নাই, সেই আদরের সন্তানের নীথর দেহ আমার চোখের সামনে। ছেলের ছবির অ্যালবামে হাত বুলিয়ে পুরনো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন মমতাময়ী মা শাহানারা আবদুল্লাহ।
ছেলের স্মৃতি হাতরাতে হাতরাতে তিনি বলেন, ‘আমার বাবু ছিল অসম্ভব মা ভক্ত। আমি যখন যা বলতাম তা মেনে নিতো। ও মাঝে মধ্যে বলতো মা তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে ঘাসের মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকবো।’ এই কথা বলেই দীর্ঘসময় তার (শাহানারা আবদুল্লাহর) কথা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি আবার শুরু করেন বলা, ‘ওর জন্ম ১৯৭১ সালের ২২জুন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ওকে বুকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে দৌঁড়িয়েছি। একদিকে আর্মি অন্যদিকে রাজাকার। আমার স্বামী (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ) বরিশাল অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন। রাজাকাররা পেলেই আমাদের মেরে ফেলবে। এই আতংকে ছিলাম সব সময়। যুদ্ধ চলাকালে দীর্ঘদিন স্বামীর সাথেও দেখা হয়নি। পরে একটি চিরকুট পেলাম। তিনি পয়সারহাট এসেছেন। সেখানে গিয়ে দেখা করি। সেই সময়ে বাবুকে বুকে নিয়ে আজকে এই বাড়ি কালকে ওই বাড়িতে দিন পাড় করেছি। ওইসময় গ্রামে দুধতো দূরের কথা ভাতও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি। ভাত টিপে টিপে নরম করে বাবুকে খাইয়েছি। বাবু রাজত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। আবার ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে ও চলে গেল। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পরেন সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের হত্যভাগ্য মা শাহানারা আবদুল্লাহ।
সেই ভয়াল কালরাতে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ঢাকার মিন্টো রোডের বাসায় বরিশালের ছয় জন নারী-পুরুষ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তারা হলেন, সাবেক মন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর বোনজামাতা কৃষককুলের নয়নমনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক সহিদ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতী সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাত এবং বরিশালের ক্রিডেন্স শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য আব্দুর নঈম খান রিন্টু। আহত হয়েছিলেন নয়জন। তারা হলেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সহধর্মিনী আমেনা বেগম, বেগম শাহানারা আবদুল্লাহ, বিউটি সেরনিয়াবাত, হেনা সেরনিয়াবাত, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, খ.ম জিল্লুর রহমান, ললিত দাস ও সৈয়দ মাহমুদ।
আক্ষেপ করে এই শহীদ পরিবারে সদস্যরা বলেন, জাতির পিতার হত্যার পরে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান ইনডিমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করে নৃশংস এই হত্যাকান্ডের বিচার কাজ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। ঘাতকদের দেশে ও বিদেশে উচ্চ পদে বসিয়ে পুরকৃত করে জিয়া। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে জিয়ার ওই কালো আইন বাতিল করে হত্যাকারীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। বিদেশে পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে স্বপরিবারে জাতির পিতা ও অন্যান্যদের হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করতে প্রধানন্ত্রীর প্রতি জোর দাবি জানান পরিবার সদস্যরা

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.