দাঁড়াও পথিকবর’ জন্ম যদি তব বঙ্গে; তিষ্ঠ ক্ষণকাল!

0
(0)
দাঁড়াও পথিকবর’ জন্ম যদি তব বঙ্গে; তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে (জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত্ত দত্ত-কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন।

যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ তীরে জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি রাজ নারায়ণ নামে জননী জাহ্নবী।’ আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি, শনিবার জন্মগ্রহণ করেন।’ পিতা রাজ নারায়ণ দত্ত ছিলেন তৎকালীন সময়ে কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের একজন সুখ্যাত আইন ব্যবসায়ী। মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন তৎকালীন সময়ে কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের একজন সুখ্যাত আইন ব্যবসায়ী। মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত কাঠিপাড়ার বিখ্যাত জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা। শিশুকালে মধুসূদনের হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁদের বাড়ির চন্ডী মন্ডপে। এরপর তিনি তাঁর গ্রামের নিকটবর্তী শেখপুরা গ্রামের এক মৌলভী শিক্ষকের নিকট ফারসী শিখতেন। এই চন্ডী মন্ডপের শিক্ষা ও মৌলভী শিক্ষকের শিক্ষায় তার প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। ১৮৩৭ সালে মধুসূদন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪১ সালের শেষদিন পর্যন্ত সেখানে ইংরেজী ও ফারসী অধ্যয়ন করেন। এই সময় খিদিরপুরে তাঁদের নিজের বাড়িতেই তিনি বসবাস করতেন।

১৮৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কবি মধুসূদন খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হন। এই সময় তিনি হিন্দু কলেজ পরিত্যাগ করে শিবপুরস্থ বিশপস্ক কলেজে ভর্তি হন এবং চার বৎসর সেখানে অধ্যয়ন করেন। এখানে অধ্যয়নকালে তিনি গ্রীক, ল্যাটিন, ফারসী, হিব্রু প্রভৃতি ভাষা আয়ত্ত করেন। ১৮৪৪ সালে কলকাতার ‘circulator’ পত্রিকায় তার অনূদিত পারস্যের কবি শেখ সাদীর একটি গজল ‘ode’ নামে প্রকাশিত হলে ইংরেজী রচনায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর পরিলক্ষিত হয়। খৃস্টধর্ম গ্রহণ করায় মাইকেল পিতার অর্থ সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে ১৮৪৭ সালে পারিবারিক স্নেহের নোঙ্গর ত্যাগ করে মাদ্রাজের পথে পাড়ি জমান। ১৮৪৮ সালে। এর আগে তিনি সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন। মাদ্রাজে গমনকালে তিনি বসন্ত রোগেও আক্রান্ত হন। এমতাবস্থায় তিনি এখানে ‘‘মেল অরফ্যান অ্যাসাইলাম’’ অনাথ আবাসিক হাইস্কুলে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। ‘টিমোথি পেন পোয়েম’ ছদ্মনামে মাদ্রাজের প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ। মাদ্রাজ সার্কুলেটর জেনারেল ক্রনিকাল, এথেনিয়াম এবং স্পেকটেটর পত্রিকায় সাংবাদিকতা ও সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ। তারপর ‘এথেনিয়াম’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ। মাদ্রাজের বিখ্যাত ব্যবসায়ী আরবুথনট কোম্পানীর কুডাপ্পা জেলার অফিস সুপারিন্টেনডেন্ট নীলকর ডুগালড ম্যাকটাভিস এরন আশ্রিত সুন্দরী কন্যা রেবেকা ম্যাকটাভিস এর সংগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। ১৮৪৯ সালে এপ্রিল মাসে প্রথমকাব্য গ্রন্থ  ইংরেজীতে লিখিত ‘দ্য ক্যাপটিভ লেডি’ প্রকাশ। মাতার মৃত্যু সংবাদ শুনে কলকাতা আগমন এবং গোপনে পিতার সংগে সাক্ষাৎ করেন। ১৮৫৪ সালে স্পেকটেটর পত্রিকায় সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন। প্রচার পুস্তিকা ‘দ্য এ্যাংলো সেক্সন এন্ড দ্য হিন্দু’ প্রকাশ। ১৮৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কবির পিতার পরলোক গমন। রেবেকার সংগে বিবাহ বিচ্ছেদ। পিতার সম্পত্তি রক্ষার্থে কলকাতা আগমন। এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইট নামে ইংরেজ কন্যাকে স্ত্রীরূপে স্বেচ্ছাগ্রহণ। এরপর জুনিয়র পুলিশ আদালতে কেরানীর পদে চাকরি লাভ। ১৮৫৭ সালে পুলিশ আদালতে দোভাষীর পদে নিযুক্ত হন। ১৮৫৮ সালে তিনি হর্ষের ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজী অনুবাদ করেন। বাংলা নাটকের দুর্দশা মোচনে ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক লিখে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং নাট্যান্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এ সময় মহারাজ যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ এবং প্রতাপ চন্দ্র সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ১৮৫৯ সালে তার শর্মিষ্ঠা নাটক পুস্তকাকারে প্রকাশ। সেপ্টেম্বর মাসে নাটকটি বেলগাছিয়া রাজাদের মঞ্চে মঞ্চস্থ, আরো নাটক রচনায় মনোনিবেশ। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং তার অল্পদিন পরেই ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামে দুটি প্রহসন রচিত হয়।

১৮৬১ সালের জানুয়ারি ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ প্রথম খন্ড প্রকাশিত। এর আগেই ১৮৬০ সালে তার ‘পদ্মবতী, নাটক প্রকাশিত হয়। মে মাসে বাংলা ভাষায় প্রথম আমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’ প্রকাশিত হয়। ১৮৬১ সালের মার্চ মাসে পাদ্রী জেমস লং সাহেবের ভূমিকা সম্বলিত ‘বাই এ নেটিভ’ ছদ্ম নামে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ। জুলাইতে ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের দ্বিতীয় খন্ড ও আত্ম বিলাপ’ কবিতা এবং ব্রজাঙ্গনা কাব্য প্রকাশ। আগস্ট মাসে বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম ট্র্যাজেডি নাটক ‘কৃষ্ণ কুমারী’ প্রকাশ। কিছুদিনের জন্য ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা সম্পাদনা। এই বছরেই কবি প্রখ্যাত সাহিত্যিক কালি প্রসন্ন সিংহের বাসভবনে অমিত্রাক্ষর ছন্দের মহাকাব্য রচনার জন্যে বিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা লাভ এবং মহাকবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

১৮৬২ সালের জানুয়ারি মাসে পৈতৃক সম্পত্তির যথোপযুক্ত বিলি ব্যবস্থায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সাহায্য প্রার্থনা এবং সহযোগিতা লাভ। বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্র কাব্য বীরাঙ্গনে প্রকাশ। স্ত্রী কন্যা পুত্রসহ জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি আগমন ও মামার বাড়ি খুলনা বাড়ুলিকাঠিপাড়া গমন। ৪ জুন বঙ্গভূমির প্রতি কবিতা রচনা। ৯ জুন কলকাতায় সম্পত্তির পত্তনি দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে ইংল্যান্ড গমন। ৩ জুলাই কান্ডিয়া নামক জাহাজে করে ইংল্যান্ড উপনীত। গ্রেজ ইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যারিস্টারি শিক্ষার জন্য ভর্তি ২ ডিসেম্বর। ১৮৬৩ সালে পত্তনির ও প্রতিভূগণের নিকট থেকে নির্দিষ্ট অর্থ না পেয়ে অর্থ সংকটে নিপতিত।

অন্যদিকে এদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে স্ত্রী হেনরিয়েটার পুত্র কন্যাসহ কোন প্রকারে পাথেয় সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে যাত্রা। ২ মে ইংল্যান্ড প্রত্যাগমন। নিদারুণ আর্থিক অনটনে ইংল্যান্ড ছেড়ে প্যারিসে গমন। সেখানকার ভার্সাই নগরীতে দৈন্যাবস্থায় দিনযাপন শুরু। ১৮৬৪ সালে ২ জুন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে অর্থ সাহায্য কামনা করে পত্র প্রেরণ। আগস্ট মাসে বিদ্যাসাগর কর্তৃক অর্থ ও সাহায্য প্রদান। আপাতত অভাব মোচন। ফরাসি, ইটালি, জার্মানি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নে ব্রতী এবং চতুর্দশপদী (সনেট) কবিতা রচনায় মনোনিবেশ। পুনরায় ইংল্যান্ড গমন এবং ব্যারিস্টারি শিক্ষা আরম্ভ। ১৮৮৫ সালে বন্ধুর নিকট কতগুলো সনেট প্রেরণ। মে মাসে ইতালীয় কবি দান্তের ৬ষ্ঠ জন্ম শতবর্ষ পূর্তি উৎসব উপলক্ষে ইতালির সম্রাটের নিকট দান্তের উদ্দেশ্যে বাংলায় লিখিত সনেট (ইতালি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদসহ) প্রেরণ। ১৮৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে লন্ডন ইউনিভার্সিটির পন্ডিত প্রবর থিয়োডোর  গোল্ডস্টুকারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার অধ্যাপক পদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ পেয়েও প্রত্যাখ্যান। আগস্ট চতুর্দশপদী কবিতাবলী, পুস্তকাকারে প্রকাশিত। নবেম্বর মাসে গ্রেজইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সসম্মানে ব্যারিস্টারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ডিসেম্বর এ ভার্সাইতে প্রত্যাগমন করে স্বদেশে আসবার প্রস্তুতি সম্পর্কে বিদ্যাসাগরকে চিঠি প্রদান।

১৮৬৭ সালের জানুয়ারি মাসে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে ফ্রান্সে রাখার ব্যবস্থা করে আর্থিক দুরবস্থার কারণে ভার্সাই বন্দর হতে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা। ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় এসে হাইকোর্টে ব্যারিস্টারী ব্যবসা শুরুর জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করেন। মার্চ মাসে হাইকোর্ট এ প্রবেশাধিকার প্রশ্নে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন। এপ্রিলে রাজা কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, রমানাথ ঠাকুর, যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্র লাল মিত্র প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সুপারিশক্রমে বিরূপ অবস্থার পরিবর্তন সাধন।

মে মাসে হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চের প্রস্তাবক্রমে অবশেষে হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি ব্যবসা শুরু। এ সময় আয় বৃদ্ধি পেলেও অমিতব্যয়িতার কারণে ঋণের দায়ে ক্রমাগত জড়িয়ে পড়া। ১৮৬৯ সালের মে মাসে স্ত্রী হেনারিয়েটার ও পুত্রকন্যাসহ কলকাতায় আগমন এবং লাইডন স্ট্রিটের প্রশস্ত বসত বাড়িতে রাজকীয় সমারোহে বসবাস শুরু। ১৮৭০ সালের জুন মাসে ব্যারিস্টারি ছেড়ে হাইকোর্টের প্রিভি কাউন্সিলের আপীলের অনুবাদ বিভাগে পরীক্ষকের চাকরি গ্রহণ করেন।

১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মধুসূদন দত্তের একমাত্র ‘হেক্টরবধ’ প্রকাশ হাইকোর্টের চাকরি ত্যাগ। ১৮৭২ সালে জানুয়ারি মাসে মোকদ্দমার তদারকি উপলক্ষে ঢাকায় আগমন এবং ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা লাভ। পুরুলিয়ায় অভিনন্দন লাভ। পঞ্চকোর্ট রাজার আইন উপদেষ্টা পদে চাকরি গ্রহণ। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় আইন ব্যবসায়ে প্রত্যাবর্তন। ডিসেম্বরে বেঙ্গল থিয়েটারের অনুরোধে অর্থের বিনিময়ে ‘মায়াকানন’ রচনা। ‘বিষ না ধর্নুগুন, নাটক রচনা শুরু। শেষ পর্যন্ত এটি সমাপ্ত করে তিনি যেতে পারেননি।

১৮৭৩ সালের এপ্রিল মাসে মধুসূদন ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য উত্তর পাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখার্জির সাদর আহবানে উত্তর পাড়া লাইব্রেরি ভবনের দ্বিতীল-এ বসবাস করতে শুরু করেন।

মে মাসে স্বাস্থ্যের ক্রমাগত অবনতি। স্ত্রী হেনরিয়েটাও নিদারুণ জ্বরে আক্রান্ত। বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতায় মধুসূদনকে খুবই পীড়িত অবস্থায় ইন্টালীর বেনে পুকুর বাড়িতে স্থানান্তরিত ও পরে প্রেসিডেন্সী জেনারেল হাসপাতালে প্রেরণ। জুনের ২৬ তারিখে স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃত্যু। জুনের ২৮ তারিখে হাসপাতালে মধুসূদনের ধর্মীয় প্রার্থনা সমাপ্তকরণ। জুনের ২৯ তারিখে রোববার বেলা দুইটায় পুত্র-কন্যা, জামাতা, বন্ধুজনের উপস্থিতিতে মধুসূদন দত্ত পরলোক গমন করেন। ৩০ জুন সেন্ট জেমস চার্চ-এর ধর্ম যাজকের উদ্যোগে কৃষ্টীয়রীতি অনুযায়ী কলকাতা লোয়ার সার্কুলার রোডে সমাধি ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে পূর্ণ মর্যাদায় মরদেহ সমাহিত।

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে যে খৃস্টান কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছিল সেখানে তার চারদিন আগে কবির জীবন সঙ্গী প্রিয়তমা স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সমাহিত করা হয়েছিল। কবির স্ত্রীর পাশেই শোয়ানো হলো কবিকে। কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের পাশে খৃস্টান কবরস্থানে কবিকে সমাহিত করলেও কবি তার সৃষ্ট কর্মের মাঝে যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।

এমনিতেই আমাদের এই মহাকবির কর্মজীবন কুসুমশোভিত ছিল না। উপার্জনের তুলনায় ব্যয়ের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়ার কারণে তার সংসার জীবনে আর্থিক দৈন্য কোনোদিনই কাটেনি।

তার জীবনের ইতিহাসে আমরা দেখি যে, তিনি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, শিক্ষকতা করেছেন, পুলিশ কোর্টের কেরানি ছিলেন সাংবাদিকতা করেছেন, আইন ব্যবসা করেছেন, অনুবাদকের কাজও করেছেন কিন্তু কোনোভাবেই কবির সংসার জীবনে আর্থিক অসচ্ছলতা কাটেনি। কপর্দক শূন্য অবস্থায় তিনি পরলোক গমন করেন।

যে কবি জন্মে ছিলেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে, কিন্তু জীবন কাটল কবির দীনতার চরম কষ্টে।

দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদিতব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল… সাগরদাঁড়ি গ্রামে কবির জন্ম ভিটায় শ্বেত পাথকে তার এই কবিতার পঙক্তি নজরে পড়লেই কবিভক্ত ও পর্যটকদের ক্ষণকাল দাঁড়াতেই হয়।

কবির জন্ম ভিটায় সাগরদাঁড়িতে গেলে বারংবার ঘুরে ঘুরে দেখতে ইচ্ছে হয় কবির জন্ম ভিটা। যার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কপোতাক্ষ নদ। যে নদ দেখলেই আপনার মনে পড়বে।

‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে!

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;

কবির ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতার লাইন দু’টি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ভিটা বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ অধিগ্রহণ করেছে। এখানে তৈরি করা হয়েছে মধুপল্লী।

মাইকেল মধুসূদন ইনস্টিটিউশন, কবির জন্ম ভিটায় প্রবেশ করতেই আপনার চোখে পড়বে কবির আবক্ষ মূর্তি। বাড়ির উঠানে জমিদার বাড়ির ঠাকুরঘর। তারপর প্রতিটি ঘরে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন আসবাব রয়েছে। বাড়ির চারপাশ ফুলের বাগানে ঘেরা। কবির জন্ম ভিটার পূর্ব ও পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী কপোতাক্ষ।

জেলা পরিষদ ডাক বাংলোর সামনেই রয়েছে কবির স্মৃতিময় ঐতিহাসিক বাদাম গাছ। যেখানে বসে কবিকে ভাবিয়ে তুলল তাঁর ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্ন। এরপর পিছনে রয়েছে বিদায় ঘাট। যেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কলকাতা থেকে স্ত্রী হেনরিয়েটা, সন্তান মেঘনাদ মিল্টন ও শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু জমিদার বাবা তাকে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেননি। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৮৬২ সালে কবি শেষবারের মতো সপরিবারে বজ্রায় চেপে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে বাড়িতে ওঠার অনুমতি মেলেনি। শেষে এই কাঠবাদাম গাছতলায় তাঁবু খাটিয়ে ১৪ দিন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। যে ঘাটে বজ্রা ভিড়িয়ে ছিলেন বর্তমানে তার নাম বিদায় ঘাট। এই বিদায় ঘাটের এখানে একটি ফলকে খুদিত রয়েছে মহাকবির রচিত ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাটি।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে কবির প্রপিতামহ রামকিশোর দত্তর বাস ছিল পাশের তালা উপজেলা অন্তর্গত গোপালপুরে। তার ছোট ভাই নিধি দত্ত। এই রাম নিধি দত্ত বাবু সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন সাগরদাঁড়ি গ্রামে। রাম নিধি দত্তের ছেলে কবির বাবা রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতায় আইন ব্যবসা করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হন এবং সাগরদাঁড়িতে জমিদারি কেনেন। কবির জন্ম ভিটার মূল বাড়ির পূর্ব-পশ্চিম পাশে জ্ঞাতিদের বাড়ি এবং কাছারি বাড়ি আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

১৯৬৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বাড়িটি প্রথমবারের মতো সংস্কার করে। গত ২০০১ সালে মধুপল্লী ঘোষিত হওয়ার পর কয়েকটি কক্ষে কবি পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে একটি জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।

এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘মধুসূদন একাডেমী। এখানে দেয়ালে স্থাপিত হয়েছে কবির লেখা কবিতা এবং ছবি। এখানে কবির সাহিত্যকর্ম, জীবনীসহ নানা বিষয়ে জানানোর ব্যবস্থাও রয়েছে।

বাংলা সাহিত্যের এক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৮৮তম জন্মবার্ষিক উপলক্ষে সাগরদাঁড়িতে এখন চলছে ‘মধুমেলা’। এই মধুমেলা ২২ জানুয়ারি থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে। এই সময় পর্যটকরা এলে মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান ও মধুমেলা দুটোই উপভোগ করতে পারবেন।

কিভাবে যাবেন : মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িতে যেতে হলে প্রথমে আপনাকে যশোর জেলা শহরে আসতে হবে। যশোর বাস টার্মিনাল থেকে বাসে কেশবপুর আসতে হবে। যশোর জেলা শহর থেকে কেশবপুর উপজেলা শহর ৩২ কিলোমিটার। আর কেশবপুর উপজেলা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরত্ব সাগরদাঁড়ি। সাগরদাঁড়ি থাকার জন্য পর্যটনের একটি হোটেল আছে। এছাড়াও কেশবপুর উপজেলা শহরে কয়েকটি আবাসিক হোটেল আছে। এছাড়া যশোর জেলা শহরে রাত্রি যাপনের অনেক উন্নতমানের আবাসিক হোটেল আছে। যা আপনারা খোঁজ করলেই জানতে পারবেন।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.