0
(0)

নাবীলা চৌধুরীঃ বাংলাদেশের লাখ লাখ গ্রাম-গঞ্জের মানুষ আজও গাছগাছড়া ও লতাগুল্ম থেকে ওষুধের ব্যবহারের মাধ্যমে নানারকম রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে , বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের লোকসংখ্যার একটি বিরাট অংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো যেমন-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা থেকে কোনো না কোনোভাবে বঞ্চিত। সেখানে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রশ্নই ওঠে না। নিকট অতীতেও আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ সাধারণ রোগবালাই নিরাময়ে ভেষজ গাছ-গাছড়া তথা দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। খেয়াল করলেই দেখতে পাই চারপাশের গাছ-গাছড়া, লতাগুল্মের মধ্যে কোনো না কোনো ঔষধি গুণ রয়েছে। ভেষজ উদ্ভিদ এর মাধ্যমে তৈরিকৃত ওষুধ আদিকাল থেকে মানব সমাজ ব্যবহার করে রোগব্যাধি মুক্ত হচ্ছে। তাইতো রাস্তাঘাটে শেকড়-বাকল বিক্রি হলে মানুষের ভিড় জমে। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত স্বাস্থ্য পরিচর্যার যত চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবিত ও প্রচলিত রয়েছে তার প্রতিটিরই বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে ভেষজ উদ্ভিদ। বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক স্বীকৃত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যা অ্যালোপ্যাথিক নামে খ্যাত। এ চিকিৎসা পদ্ধতির বহু ওষুধ আসে উদ্ভিদ থেকে। উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ক্যানসার চিকিৎসার ক্যামোথেরাপিতে ব্যাপকভাবে নয়নতারা ও ক্যাকটাস ব্যবহৃত হচ্ছে। আজ ভারতীয় উপমহাদেশের সবক’টি দেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে হোমিওপ্যাথিক, যার অধিকাংশ ওষুধ আসে ভেষজ উদ্ভিদ থেকে।

অর্থাৎ পৃথিবীর মানুষ যতদিন বাঁচবে ততদিন গাছগাছড়া, লতাগুল্মের ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। সেজন্য জনস্বাস্থ্য ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বর্তমান সময়ে ভেষজের চাষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভেষজ ঔষধি গাছ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ামুক্ত, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী, ভেষজ ওষুধে রোগ পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। এ কারণে বিশ্বব্যাপী ভেষজ উদ্ভিদের উৎপাদন ও ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য নিজস্ব উদ্যোগ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানারকম আয়বর্ধক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হচ্ছে তারা। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক বনায়ন, সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। তেমনি ঔষধি গাছ উৎপাদনের মাধ্যমেও দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব। তবে তা হবে পরিকল্পিত বাগান স্থাপন। প্রয়োজনমতো ভেষজ উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে আর্থিক আয়। নিজস্ব অথবা যৌথ উদ্যোগ ছাড়াও স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ঔষধি গাছের বাগান স্থাপন ও উৎপাদন করা।

এলাকাভিত্তিক সহজলভ্য গাছ নির্বাচন করতে হবে, যাতে সহজেই বিপণন করা যায়। বাগানে কিছু বড় বড় ঔষধি গাছ ছাড়াও ছোট ও লতাগুল্ম গাছ লাগালে ভালো হবে। যেমন- অর্জুন, আমলকী, বহেরা, হরীতকী, বেল, সজিনা, শিমুল, ছাতিম, তেজপাতা, পলাশ, তুত, চম্পাফুল, গর্জন, অশ্বত্থ, চালতা, এলাচি, দারুচিনি, করমচা, নিম,নিশিন্দা , লেবু,তাল, জামির,ডুমুর এবং লতা জাতীয় তুলসী, থানকুনি, বসাক, কালোমেঘ, ঘৃতকুমারী, পাটশাক, তেলাকুচা, শতমূল, সর্পগন্ধা, লজ্জাবতী, মেহেদি, আদা, ভেরেন্ডা ও হেলেঞ্চা ইত্যাদি। বড় গাছগুলো একটি থেকে আরেকটি ৫ মিটার দূরে লাগাতে হবে। লতা জাতীয় গাছ মাচা দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় লাগালেই হবে। চাষের জন্য সঠিক প্রাকৃতিক পরিবেশে জৈব সার প্রয়োগ করে ঔষধি গাছের উৎপাদন করতে হবে। তা না হলে ঔষধি গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে। সেজন্য মাটির উর্বরতা, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, সেচ, সার ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে হবে।

 

 

উৎপাদিত ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ গুদামজাতকরণ:
ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদন করার পর তাকে ঠিক সময়ে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ বা গুদামজাত না করলে তার ভেষজ গুণ ঠিকমতো থাকে না বা কার্যকরী হয় না। তাই অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ বিষয়ে বিশেষ বিধি মেনে চলার বিধান রয়েছে। ভেষজ সংগ্রহ পদ্ধতি ও সংরক্ষণ ঔষধি দ্রব্য বা ভেষজ নতুন ও পরিপুষ্ট হতে হবে। পোকামাকড় দ্বারা নষ্ট হয় নাই এমন। যে ঋতুতে যেই ফুল-ফল উৎপাদন হয় তা ওই ঋতুতেই ব্যবহার করতে হবে। উদ্ভিদ যখন ফুলে-ফলে সুশোভিত থাকে ওই অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে। শীত ও গ্রীষ্মকালে উদ্ভিদের মূল সংগ্রহ করতে হবে। বসন্তকালে পাতা সংগ্রহ করতে হয়।

শরৎকালে উদ্ভিদের ছাল, কন্দ এর ক্ষীর সংগ্রহ করতে হয়। হেমন্তকালে গাছের কাষ্ঠল বা সার সংগ্রহ করতে হয়। যেই ঋতুতে যেই ফুল-ফল জন্মে ওই ঋতুতেই তা সংগ্রহ করতে হয়। উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে যে যে অংশ ঔষধি গুণসম্পন্ন যেমন- পাতা, ফুল, ফল, ছাল, মূল ইত্যাদি উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করে ভালোভাবে পরিষ্কার করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া যেমন-শতমূলী, ঘৃতকুমারী, ওলটকম্বল, চাল কুমড়া ইত্যাদি বিশেষ পদ্ধতিতে শুকিয়ে নিতে হবে। যেন ভেষজগুলো পচন না ধরে, বিশ্রী গন্ধ না হয়ে যায় বা বদ রঙ না হতে পারে এমনভাবে শুকাতে হবে। যেভাবে চা-পাতা প্রসেস করা হয়। ওই পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। (উষ্ণ বাতাস) কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোদে শুকানো যেতে পারে।

 

বীজের ক্ষেত্রে রোদে শুকানো উত্তম।শুষ্ক ভেষজগুলো গুদামজাত করার জন্য উন্নত পলিথিন, চট, প্লাস্টিক, স্টিলের ড্রাম, বস্তা ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রেই শুষ্ক হতে হবে। যে গুদাম রাখা হবে তার ভেতর যেন বদ্ধ, গুমট হাওয়াযুক্ত না হয়। বাতাস যেমন চলাচল করতে পারে এমন গুদাম হতে হবে। পুরাতন স্যাঁতস্যাঁতে বদ্ধ ভবনে কখনও এসব ভেষজ রাখার স্থান নির্বাচন করা যাবে না। যেসব ভেষজ কাঁচাই ব্যবহার করতে হয় ওই ক্ষেত্রে হিমায়িত কক্ষ ব্যবহার করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকা লতা, পাতা, গুল্ম, বৃক্ষ ইত্যাদিতে ভরপুর চির শ্যামল এ বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদের কমতি নেই। এখানে যেমন ঔষধি ভেষজ আছে প্রচুর তেমনি চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। অতএব, ভেষজ উদ্ভিদের চাষ করে আর্থিক আয়ের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হন, দারিদ্র্য দূর করুন এবং মানবসেবায় অবদান রাখুন। আল্লাহর দেয়া দানকে কাজে লাগান।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.