0
(0)

মোঃ আহছান উল্লাহঃ রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/ এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে? /সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে? / তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে; / অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি….কবির পুরো ইতিহাস লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হবে তাই সংক্ষেপে এক শক্তিমান ও অনন্য দিকপাল কবি ব্যক্তিত্ব। মহাকবি, শিশু সাহিত্যিক, মুসলিম জাগরণের কবি, মানবতাবাদী কবি প্রমূখ পদবী দ্বারা সাহিত্যরস বোদ্ধা কবি ফররুখ আহমদ | আজ ১০জুন ২০১৯ সোমবার এই মহাকবির ১০১ তম জন্মদিন । মাতৃভাষা ও দেশমাতৃকার প্রতি এই বিপ্লবী কবির ছিল অগাধ প্রেম । যুগশ্রষ্টা এ কবি যশোর জেলার মাগুরা থানার মাঝআইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর সৈয়দ হাতেম আলী। তাঁর মার নাম রওশন আখতার। মার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি । তাঁরা তিন ভাই, দুই বোন।

মাঝআইল গ্রামের পাঠশালায় ফররুখ কিছুদিন পড়েছিলেন। ফারসি-জানা এক মহিলা বাড়িতে এসে তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে মডেল এম.ই.স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর কিছুদিন পড়েন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। এর পর ফররুখ ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। এই স্কুলে তাঁর শিক্ষক ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেম। এই স্কুলের ম্যাগাজিনে ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এই স্কুল থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। কলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে আই.এ. পাশ করার পর ঐ বছরই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে বি.এ.-তে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। তাঁর অধ্যাপকমণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ। স্কুল-কলেজে তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিকার সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

কলকাতায় থাকাকালীন ফররুখ আহমদ অনেকগুলি চাকরি করেছেন। কিন্তু সবগুলিই ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে, ১৯৪৫ সালে মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি।

ঢাকা বেতারেই ফররুখ আহমদ দীর্ঘদিন চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং আমৃত্যু ঢাকা বেতারে ষ্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখের বিবাহ হয়। তৈয়বা খাতুনের বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ নূরুল হুদা। বিবাহের উদ্যোক্তা ছিলেন ফররুখ ও তৈয়বা খাতুনের নানা মোহাম্মদ হুরমাতুল্লাহ। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়। ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), হাতেমতায়ী (১৯৬৬), হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১) ইত্যাদি। পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ইত্যাদি তাঁর শিশুতোষ রচনা।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬১), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০) লাভ করেন।  বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভাধর কবি ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলা ঢাকায় ইস্কাটন গার্ডেনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফররুখ আহমদের মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সনে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে ভাষা আন্দোলনে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ১৯৮০ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়।

 

২৩শে জুন ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ঘষেটি বেগম ও মীর জাফরদের ষড়যন্ত্রের ফলে অস্তমিত হওয়ার ফলে বিপ্লবী কবি ফররুখ দেখেছেন ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন ও শোষণের অবস্থা। এ দেশবাসীর জন্য স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। আরো উপলব্ধি করেছেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য সুযোগ্য নেতা প্রয়োজন। ছন্দে তিনি যাদুকর ছিলেন না, ছিলেন বিপ্লবী।

‘মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর

সাক্ষী তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরনীর পর।’

[লাশ: সাত সাগরের মাঝি]

 

তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে লেখনী পরিচালনা করেন। এভাবে যখন চলে আসে উত্তাল কাল ১৯৭১ সাল। তখন মাতৃভূমি বাংলাদেশে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। হাতে বন্দুক নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ না করলেও তিনি স্বাধীনতার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর সম-সাময়িক অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবীকে দেখা গেছে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে ও দেশ স্বাধীনের পরে নিজেকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে প্রচার করতে।

মহান কবি ফররুখ আহমদ অমর হয়ে থাকবেন যতদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে। আমরা কবি ফররুখ আহমদকে একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মান জানাতে মানবতাবাদী কবির অসংখ্য লেখা এখনো যা অপ্রকাশিত রয়েছে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হোক এ কামনা করি।

ফররুখের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৫। যথাঃ ১। সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪) ২। আজাদ কর পাকিস্তান (১৯৪৬), ৩। সিরাজম মুনীরা (১৯৫২), ৪। নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), ৫। মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), ৬। হাতেম তা’য়ী (১৯৬৬) ৭। হে বন্য স্বপ্নেরা (১৯৭৬), ৮। ইকবালের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮০), ৯। কাফেলা (১৯৮০), ১০। হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১), ১১। তসবির নামা (১৯৮৬), ১২। দিলরুবা (১৯৯৪), ১৩। ঐতিহাসিক অনৈতিকহাসিক কাব্য (১৯৯৪), ১৪। অনুস্বার, ১৫। ধোলাই কাব্য।

‘সাত সাগরের মাঝি’ ফররুখ আহমদের প্রথম এবং সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। মূলত: এ গ্রন্থে ফররুখ আহমদের স্বাধীনতা-প্রীতি ও মানবতাবোধের সুস্পষ্ট বিকাশ ঘটেছে।

ফররুখ আহমদের লেখা গান আজো আত্মবিশ্বাসী করে তোলে নতুন প্রজন্মকে। ‘তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া, তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাড়া’- এমনি অসংখ্য গান-কবিতা আর সাহিত্যর মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে যুগ থেকে যুগান্তরে বেঁচে থাকবেন কবি ফররুখ আহমদ।

 

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.