রুটির দোকান থেকে মানুষের অন্তরে

0
(0)

শান্ত পথিক//
গণ-মানুষের কবি, সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল হাজার রকম বৈচিত্র্যে ভরা।
প্রথম জীবনে আসানসোলে রুটির দোকানের কর্মচারী পরে সেনাবাহিনীর হাবিলদারের জীবন এবং
তার সৃষ্টিশীল লেখক জীবন। নানা বৈচিত্র্য ও বর্ণাঢ্য ভরা ছিল তার জীবন। তাঁর জীবনের নানা অংশ
জুড়ে জড়িয়ে আছে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল হাজার রকমের বৈচিত্র্যে ভরা। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি ও সংগীতজ্ঞ। তার জন্ম ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে। ১৯০৮ সালে মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। পিতার এই মৃত্যুর পর তার জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে নজরুলের শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে জীবিকা অর্জনের জন্য নামতে হয়েছিল পথে পথে। এমনকি স্থানীয় মসজিদে কিছুদিন কাজও করেছেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ১৯১০ সালে এসব ছেড়ে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন ছাত্রজীবনে। শুধু তাই নয়, শুনলে অনেকেই অবাক হবেন যে তাকে কিছুদিন আসানসোলের রুটির দোকানেও কাজ করতে হয়েছিল। এভাবে বেশ কষ্টের মধ্যেই তার বাল্যজীবন শুরু হয়। এই রুটির দোকানে কাজ করার সময়েই আসানসোলের দারোগা রফিজুল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন।
পরে তিনি ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯১৭ সাল পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেন। সে বছরেই শেষের দিকে মাধ্যমিক পরীক্ষা না দিয়ে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। প্রায় আড়াই বছর ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক করপোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার হয়েছিলেন। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস করেন। তার সঙ্গে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফফর আহমদ এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরুণী, কোরবানি, মোহররম, ফাতেহা-ই-দোয়াজদম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। ১৯২০ সালের জুলাই মাসে নবযুগ নামের একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলার একে ফজলুল হক এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ওই বছরই এই পত্রিকায় “মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে? শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়।
তিনি ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। রবীন্দ্রনাথের শেষদিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯২১ সালে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচিত হন। তার সঙ্গেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সঙ্গে যার সঙ্গে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়। নজরুল যখন খুব অসুস্থ ছিলেন তখন প্রমীলা দেবী নজরুলের খুব পরিচর্যা করেন এবং তাকে সারিয়ে তোলেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও চার সন্তানের নাম হিন্দু এবং মুসলিম উভয় নামেই নামকরণ করেন।
১৯২২ সালের ১২ই আগস্ট নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হত। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রায় চার হাজার গান, বহু কবিতা রচনা করেন।
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। আর ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকেন। এই প্রসঙ্গে জানাই বাংলাদেশ যাওয়ার আগে তিনি টালা পার্কের কাছে একটি বাড়িতে থাকতেন। আমি তখন টালাপার্কের মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম আর সেই বাড়িটির দিকে সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকতাম এই আশায় যে যদি কবিকে এক মুহূর্তের জন্যও দেখতে পাই। কিন্তু আমার সে আশা একদিন সফল হয়েছিল। জানালা দিয়ে এক-ঝলক কবিকে দেখেছিলাম। শুনেছিলাম তিনি খুবই অসুস্থ। তাই কারও সাথে সাক্ষাতের অনুমতি ছিলনা। পাঠকেরা হয়তো অনেকেই জানেন যে তাকে যখন বন্দী করে রাখা হয়েছিল হুগলী জেলে তখন ওই জেলের দেওয়ালের কাছে এসে কবি যখন উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরতেন – কারার ওই লৌহ কপাট ইত্যাদি তখন হুগলী স্টেশনের ফ্লাটফর্মে লোকের ভিড় লেগে যেত। আমি ছাত্র থাকাকালীন হুগলী স্টেশনে গিয়ে ওই জায়গাটি নিজের চোখে দেখে এসেছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছিল ওটি একটি পুণ্যস্থান। তার গান আজও আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়।
বাংলাদেশ তাঁকে জাতীয় কবির সম্মান প্রদান করেছে। তিনি বিদ্রোহী কবি নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দে অন্যায় এবং অনাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে। তিনি শুধু বিদ্রোহী নন, তিনি প্রেমিক, তিনি দুঃখী, তিনি পিতা, তিনি বাক-হীন অবুঝও। তিনি যখন কবিতায় বিদ্রোহের কথা বলেন তখন আমরা জেগে উঠি অধিকার আদায়ে। যখন প্রেমের কথা বলেন তখন গভীর প্রেমাবেগে আমরা দিশে হারাই। আপন সত্তাকে বারবার নতুন-রূপে আবিষ্কার করি; যে সত্তা ঘুমিয়ে থাকে আর একমাত্র নজরুল বারবার জাগিয়ে তোলেন। বাংলা কবিতার পটভূমিতে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবকে তুলনা করা হয়েছে ধূমকেতুর সঙ্গে। যদিও তাঁর খ্যাতি শীর্ষ স্পর্শ করেছে বিদ্রোহী কবি হিসেবে। তবে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধেই শুধু তাঁর বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। অন্য নজরুল প্রেমময়, জগতের শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। কখনো কখনো বিরহী, আবার প্রেমে আঘাত পেয়ে আহত, ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের এক প্রেমিক। সেই প্রেম প্রিয় নারীর জন্য, সেই প্রেম সন্তানের জন্য, সেই প্রেম দেশের জন্য, সেই প্রেম নিপীড়িত-শোষিত মানুষের জন্য। আসলে কবি নজরুলকে কোনও একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে আবদ্ধ করা বড় কঠিন।
কবি নজরুলকে বিপ্লবী-প্রেমিক কবি হিসেবে মূল্যায়ন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন আমাদের গবেষক-বিশ্লেষকরা। নজরুলের কবি-স্বভাব চিহ্নিত করার এই ধারা বিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই শুরু হলেও কোনও অস্তিত্ব-গত পরিস্থিতিতে নজরুলের শিল্পী সত্তার যুগান্তকারী বিস্তার, সেই প্রসঙ্গটি বহুলাংশে এখনো অধরাই রয়ে গেছে। শৈশব থেকেই দুর্ভাগ্য আর অস্থিরতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। মানস বিকাশের যে স্তরে প্রয়োজন সুস্থির পারিপার্শ্বিকতা তা নজরুল পাননি।
নজরুল শুধু একজন কবি নন। তিনি একজন পথপ্রদর্শক। জীবনের চরম দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতিতেও কীভাবে আত্মশক্তি ধারণ করতে হয়, কীভাবে নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয় এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ কবি নজরুল, এমন একজন ব্যক্তি নজরুল। তিনি ধর্মভীরু হয়ে গজল রচনা করে দীনভিখারীর চোখে জল এনে দিয়েছেন আবার কীর্তনের মাতমে মাতয়োরা করেছেন ভক্তদের। নজরুলের ভিন্নতা এখানেই। তিনি সব ধর্মের ঊর্ধ্বে আবার তিনি নতজানু সৃষ্টিকর্তার দরবারে। যুগে যুগে নজরুল বেঁচে থাকবেন তার কবিতায়, গানে, কীর্তনে। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের মনে জীবনীশক্তির আধার হয়ে। তাঁর জীবনাচরণ অনুসরণ করে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকারও থাকতে হবে একইসঙ্গে।
১৯৫৩ সালের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিত্সার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পি জি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মারা যান। তিনি আমাদের অন্তরের কবি। সমাজ চেতনার কবি। এক নবজাগরণের কবি। স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ কখনোই ভুলতে পারবেনা। তিনি আমাদের কাছে অমর হয়ে আছেন এবং অমর হয়ে থাকবেন। তাঁকে আমরা প্রণাম জানাই।
সূত্র – দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

Average rating 0 / 5. Vote count: 0

No votes so far! Be the first to rate this post.